বৈসাবি উৎসবে মেতেছে পাহাড়ি সম্প্রদায়রা। বাংলা নববর্ষ বরণ এবং বর্ষ বিদায় উৎসবকে পাহাড়ের সম্প্রদায়রা ভিন্ন নামে পালন করে আসছে বহুকাল ধরে।মারমা ভাষায় সাংগ্রাই, ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বিষু এবং চাকমা ভাষায় বিজুর সংক্ষেপিত রূপ হচ্ছে বৈসাবি। পাহাড়ি চার সম্প্রদায়ের প্রধান এই সামাজিক উৎসবকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় বৈসাবি।
বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় বালাঘাটামুখ ঘাটে সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসানোর মাধ্যমে বান্দরবানে চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু এবং তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বিষু উৎসব শুরু হয়েছে।ফুল পূজায় চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর এবং নারী-পুরুষরা অংশ নেয়। পরে বালাঘাটা স্কুলমাঠে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ঐহিত্যবাহী ঘিলা খেলা অনুষ্ঠিত হয়।বিষু উৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা জানান, ঘিলা হচ্ছে জঙ্গলি লতায় জন্মানো এক প্রকার বীজ বা গোটা।ঘিলা তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের নানা কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় বস্তু। তঞ্চঙ্গ্যার সম্প্রদায়ের বিশ্বাস-ঘিলার লতায় ফুল থেকে বীজ (গোটা) জন্মালেও এর ফুল পবিত্র দেবংশি (স্বর্গীয়) বস্তু হওয়ায় সাধারণ মানুষ ঘিলা ফুলের দেখা পান না।শুধু যারা মহামানব হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন তারাই একমাত্র ফুলের দেখা পান। ফুলের পরিবর্তে ঘিলা (বীজ গোটা) পবিত্র হিসেবে সংগ্রহ রাখেন তঞ্চঙ্গ্যারা। ঘিলা বাড়িতে রাখলে বজ্রপাত বিপদ এবং অপদেবতা বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না।পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি ঘিলা খেলার উদ্ধোধন করেন। ঘিলা খেলা টুর্ণামেন্টে ৩২টি পাড়ার তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়া বয়স্ক পূজা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে।

বিজু উৎসব কমিটির সদস্য বিকাশ চাকমা জানান, নদীতে ফুল ভাসানোর মাধ্যমে তাদের বিজু উৎসব শুরু হয়। এ ছাড়া চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলা নাটিং এবং বাঁশহরম প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক আয়োজনও রয়েছে।এদিকে মারমাপ্রধান বান্দরবানে অতীতের ব্যর্থতা আজ মুছে দিয়ে যায়, নতুনের অঙ্গীকার আর উদ্দীপনায় প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে শুক্রবার সকালে ৮টায় পুরাতন রাজবাড়ি মাঠ থেকে আপন ঐতিহ্যে সাজো: বর্ণাঢ্য সাংগ্রাই র‌্যালির মাধ্যমে চার দিনব্যাপী উৎসব শুরু হবে। র‌্যালির নেতৃত্বে দেবেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।র‌্যালিটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাজবাড়ী মাঠে গিয়ে শেষ হবে। র‌্যালিতে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ¤্রাে, চাক, খেয়াং, খুমি, বম, লুসাই, পাঙ্খোয়া সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী এবং শিশু-কিশোরসহ নারী-পুরুষেরা অংশ নেন।তারপর পুরাতন রাজবাড়ী মাঠে শিশু-কিশোরদের চিত্রাংকন প্রতিযোগী এবং বেলা ১১টায় বসস্ক পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পরের দিন ১৪ এপ্রিল দুপুরে আড়াইটায় উজানিপাড়াস্থ সাঙ্গু নদী চড়ে অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র বুদ্ধমূর্তি স্নান।রাজগুরু কিয়াং হতে সাড়িবদ্ধভাবে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুরা (ভান্তেরা) কষ্টি পাথর এবং স্বর্ণের বৌদ্ধ মূর্তি সহকারে পায়ে হেঁটে নদীর চড়ে গিয়ে সমবেত হবে। সেখানে সম্মলিত প্রার্থণায় বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ এবং তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোররা অংশ নেন।রাতে সাড়ে ১০টায় উজানিপাড়াস্থ বিসিক গলি, মধ্যমপাড়াস্থ ছয় নাম্বার গলি, জাদিপাড়া গলিসহ বিভিন্ন মহল্লায় তরুণ-তরুণীদের পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা চলবে। রাতব্যাপী সারিবদ্ধভাবে বসে তরুণ-তরুণীরা হরেকরকমের পিঠা তৈরি পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিতরণ করে। সাংগ্রাই উৎসবের মূল আকর্ষণ-মৈত্রী পানি বর্ষণ জলকেলি উৎসব অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৫ ও ১৬ এপ্রিল বিকালে জেলা শহরের পুরাতন রাজবাড়ী মাঠে, সদর উপজেলার রেইছাথলিপাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার হাইস্কুল মাঠে তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠবেন জলকেলি বা পানি খেলায়।জলকেলি উৎসবে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে ভাবের আদান-প্রদান করেন। জলকেলির আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে- পানি খেলায় বিবাহিত নারী-পুরুষরা অংশ নিতে পারে না। জলকেলি উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা সস্পর্কের সেতুবন্ধ তৈরি করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়।ওই দিন সন্ধ্যা ৭টায় পুরনো রাজবাড়ী মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মারমা শিল্পীগোষ্ঠীসহ স্থানীয় শিল্পীরা নাচ-গান পরিবেশন করবে।সেদিন রাত সাড়ে ১০টায় উজানী পাড়াস্থ বিসিক গলি, মধ্যমপাড়াস্থ ছয় নাম্বার গলি, জাদিপাড়া গলিসহ বিভিন্ন মহল্লায় তরুণ-তরুণীদের পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা চলবে।এ ছাড়া সন্ধ্যা ৭টায় রাজগুর বৌদ্ধ বিহারসহ (ক্যায়াং) বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারগুলোতে হাজারো মঙ্গল প্রদ্বীপ প্রজ্বালন অনুষ্ঠান হবে। এ সময় হাজার হাজার প্রদ্বীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে পাহাড়ি নারী-পুরুষরা প্রাথয় দেশ ও জাতীর মঙ্গল কামনা করা হবে বলে জানিয়েছেন সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি কোকোচিং মারমা।