মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি-এ মর্মবাণীকে প্রতিপাদ্য করে এবার বাংলা নববর্ষ বরণে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এ শোভাযাত্রায় অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ।অমঙ্গল- গ্লানি দূর ঠেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উন্নয়নশীল দেশ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।বরাবরের মতো বাংলা নববর্ষ ১৪২৫কে বরণ করতে এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।এ শোভাযাত্রাতে অংশ নিতে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষ জড়ো হন চারুকলার সামনে।

বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃত এ শোভাযাত্রাকে ঘিরে এবার ছিলো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। র্যা ব, পুলিশ, সোয়াট সদস্যরা মঙ্গলশোভার সামনে গড়ে তোলে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। বেলা ৯টা বাজতে চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় এই শোভাযাত্রা।উজ্জীবিত সূর্যের আহ্বানে এবার মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” মরমী সাধক লালনের এই গানকে প্রতিপাদ্য করা হয় এবারের যাত্রায়। ঢাক-ঢোলের বাজনার তালে তালে সবার কণ্ঠে এই গানের সঙ্গে এগিয়ে চলে শোভাযাত্রা। বৈশাখের সাজে মিছিল করে এল গরু, মহিষ, হাতি, টেপা পুতুল এল সাইকেলে চেপে; শিশু কোলে সঙ্গী হলেন মা, ছানা নিয়ে চলল মা পাখি, জাল নিয়ে জেলে আর মাছের সঙ্গে বকও এল। বরাবরের মতই সামনে থাকলেন রাজা-রাণী। মঙ্গলের এই যাত্রায় আলো ছড়ালো সূর্যমুখের হাসি।

সূর্যের সেই আলোয় মনের আঁধার কাটিয়ে মানব বন্দনায় সোনার মানুষ হয়ে ওঠার আহ্বান এল এবারের বর্ষবরণ উৎসবের মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে।লালনের দর্শনে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’- এই প্রতিপাদ্যে বঙ্গাব্দ ১৪২৫ কে বরণ করে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ শরিবার এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে।বৈশাখের প্রথম সকালে চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক রূপসী বাংলা) চত্বর ঘুরে টিএসসি হয়ে আবার চারুকলার সামনে এসে এই বর্ণিল যাত্রার শেষ হয়। শোভাযাত্রার পুরোভাগে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, প্রক্টর গোলাম রাব্বানী ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ হবে।

উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, লালন বলেছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।লালনের ‘সোনার মানুষ’ শব্দবন্ধের সাথে বঙ্গবন্ধুরসোনার বাংলা’ শব্দবন্ধের বেশ মিল পাওয়া যায়। এই নতুন বছরে আমাদের কামনা আমরা সোনার মানুষ হয়ে সোনার বাংলা বিনির্মাণে এগিয়ে যাব। বৈশাখী সাজে সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষের এই শোভাযাত্রায় সামনে-পেছনে ঢাকের বাদ্যের তালে তালে চলে নৃত্য, হাতে হাতে ছিল বড় আকারের বাহারি মুখোশ, শোলার পাখি আর টেপা পুতুল।১৯৮৯ সালে স্বৈরাচার বিরোধী ভাবমূর্তি নিয়ে চারুকলা থেকে শুরু হয় পহেলা বৈশাখের এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সময়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে তা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম পায়। বাঙালির বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা বখেন ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল হেরিটেজ’ এর অংশ। শোভাযাত্রা আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন জানিয়েছিলেন, মানুষের মধ্য প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার যে আকাঙ্খা, লালন সাঁইজির গান থেকে মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ প্রতিপাদ্যে সেই বারতাই তারা ছড়িয়ে দিতে চান মঙ্গল শোভাযাত্রায়।সেই ভাবনা থেকেই সাজানো হয়েছ এবারের শিল্পকাঠামোগুলো।এবারের শোভাযাত্রার অগ্রভাগে ছিল ‘সূর্য’, যার চারদিকে ছিল সাতটি ফুল। চারুকলার শিক্ষার্থীরা জানান, মানুষকে আলোকিত করার প্রত্যয়ে এবার এই প্রতীক।পহেলা বৈশাখের সকাল থেকেই চারুকলা-টিএসসিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জনসমাগম বাড়তে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজপথ পরিণত হয় বৈশাখের লাল-সাদা জন¯্রােতে। গ্রীষ্মের খরতাপ উপেক্ষা করেই বাঙালি মেতে ওঠে উদযাপনে।গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়েছে নিরাপত্তার কড়াকড়ির মধ্যে। পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন ও সোয়াটের সদস্যরা অস্ত্র হাতে সামনে-পেছনে গড়ে তোলেন নিরাপত্তা বলয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসির সদস্যরাও ছিলেন তাদের সঙ্গে। মাথার ওপর টহল দেয় র‌্যাবের হেলিকপ্টার।পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা সাইফুল রহমান খানিকটা বিরক্ত সুরেই বলেন, নিরাপত্তার কড়াকড়ি একটু বেশিই ছিল। শোভাযাত্রা শেষ করে উপাচার্য-প্রক্টরসহ শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির আয়োজনে প্রীতি ভোজে অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পান্তা-ইলিশে বৈশাখী ভোজ সারেন উপাচার্য। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন এ সময়।