বিগত ১০ বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মা-মাছের (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) অধিক পরিমাণে দেওয়া ব্যস্ত সময় পার করছেন হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা। তারা কেউ নিজের তৈরী সনাতন পদ্ধতিতে কুয়ায়, আবার কেউ সরকারী হ্যাচারীর মাধ্যমে নদী থেকে সংগৃহীত ডিম পরিস্ফুটনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তবে বেশ নাজুক অবস্থা সম্পন্ন সরকারী হ্যাচারী গুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো মদুনাঘাট, মাছুয়াঘোনা শাহ্ মাদারী হ্যাচারীতে পরিস্ফুটনের জন্য রাখা ডিম সংগ্রকারীদের নিষিক্ত ডিম থেকে উৎপাদিত অনেক রেণু নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে করে হালদা নদী থেকে সংগৃহীত ডিম সংগ্রহকারীদের মাথায় হাত পড়েছে।

হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শা এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়–য়া অভিযোগ করে বলেন, আগে থেকে মদুনাঘাট হ্যাচারি প্রস্তুত না থাকায় রেণু ফোটানোর জন্য প্রয়োজনী পানি পাওয়া যায়নি। হ্যাচারির পুকুরে পানি নেই। এমনকি হ্যাচারির পানির কলটিও নষ্ট। তাই পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে আমার দুই কুয়ার ৫ কেজির বেশি রেণু নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া মিন্টু বড়–য়ার ২টি, আনন্দ বড়–য়ার ১টি কুয়াসহ বেশ কয়েকজনের রেণু নষ্ট হয়ে গেছে।সরেজমিনে গেলে হাটহাজারীর মাছুয়াঘোনার হ্যাচারিতে কথা হয় স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী দুলাল জলদাসের সাথে। তিনি বলেন, সরকারি হ্যাচারিতে রেণু ফোটানোর কুয়া আছে ৪৬টি। এরমধ্যে ৩০টি আগে থেকে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। অবশিষ্ট ১৬টি কুয়া রেণু ফোটানোর উপযোগী রয়েছে। একটি কুয়ার ধারণক্ষমতা ৫ বালতি করে ডিম। কিন্তু এবার রেকর্ড পরিমাণ ডিম পায় আহরণকারীরা। এ অবস্থায় তারা প্রয়োজনীয় কুয়া না পেয়ে ১৬ কুয়াতে নিরূপায় হয়ে অতিরিক্ত ডিম দেয়। এতে দ্বিতীয় দিনে বেশিভাগ রেণু মারা যায়।স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী জানান, আশা ছিল আরহিত ডিম পরিস্ফুটন তথা রেণুতে পরিণত করে মৎস্য খামার মালিক, মৎস্য চাষী ও রেণু ব্যবসায়ীরাদের কাছে বিক্রি করে দেনা ও ঋৃণ শোধ করব। সাথে সাথে পারিবারিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি করা। কিন্তু হ্যাচারী ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের স্বেচ্ছাচারীতা ও হেঁয়ালিপনার কারণে হ্যাচারীতে রাখা অনেক রেণু নষ্ট হয়ে গেছে।

এদিকে গত শুক্রবার সকাল থেকে হালদা পাড়ের জেলেরা প্রথমে সনাতন পদ্ধতিতে মশারির নেট দিয়ে তৈরী বিশেষভাবে এক ধরণের জাল পেতে ডিম তোলে নিয়েছিল নৌকায়। তার আগে নৌকার মাঝে তক্তা ও মাটি দিয়ে কৃত্রিম পুকুরের মত তৈরী করেছিল। আর এই গর্তে সূতির মিহি কাপড় দিয়ে তাতে ডিম রাখার ব্যবস্থা করে। এরপর নদীর তীরে মাটির তৈরী অগভীর কুয়ায় ছেড়ে দিয়ছিল সংগৃহীত ডিম। ডিমকে কুয়ার মাঝে পরিস্ফুটনের জন্য ৭/৮ মিনিট অন্তর অন্তর নাড়াছাড়া করতে হয় যাতে ডিমগুলো ফুটানোর পর রেণুগুলো জালের নিচে পানির মধ্যে চলে যায়। যখন দেখা যায় রেণুগুলো জালের উপর নেই তখন জাল ধুয়ে পরিস্কার করে ফেলতে হয়। তারপর সদ্য রেণুগুলো ধুয়ে পরিস্কার করা জালে নিয়ে আরেকটি কুয়ার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। নতুন কুয়ায় ছেড়ে দেওয়ার ১৫/২০ মিনিট পর এই রেণুগুলোর চোখ ফোটে ও পূণতা পাই। কিন্তু তখনও তাদেরকে চেনা যায় না। এভাবে ১০/১২ দিন পর রেণুগুলো পরিপূণতা লাভ করে। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন জানান, হালদা নদীর মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য আইডিএফ গৃহিত কর্মসূচির মাধ্যমে হালদা নদীতে মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টির জন্য এ প্রকল্প কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৭শ জন ডিম সংগ্রহকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পিকেএসএফ এর অর্থায়নে এ প্রকল্পের মাধ্যমে আইডিএফ প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ জনকে ডিম থেকে রেণু ফোটানোর জন্য ৪০টি মাটির কুয়া স্থাপন করা হয়েছে। এসব কুয়ায় কোন প্রকার সমস্যা ছাড়ায় অনেকটা সনাতন পদ্ধতিতে নিষিক্ত ডিম পরিস্ফুটন করছে।অন্যদিকে মদুনাঘাট হ্যাচারী এলাকায় দেখা গেছে এই হ্যাচারিতে ডিম থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য যে ট্যাঙ্কগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে ভালো আছে কয়েকটি। অন্যান্য ট্যাঙ্ক গুলোতে কোনো রকমে সংস্কার করে সেখানে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম থেকে রেণু তৈরীর কাজ করছেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ডিম সংগ্রকারী জানান, এত বড় হ্যাচারিটি ঠিক থাকলে অনেক ডিম সংগ্রহকারী এটি থেকে সুফল পেত। অনিরাপদ মাটির কুয়ায় ডিম রেখে ঝুঁকির মধ্যে ডিম ফুটাতে হতো না। সরকারী হ্যাচারী গুলোতে অব্যবস্থাপনার কারণে নদী থেকে সংগ্রহ করা ডিম নিয়ে অনেকেই বিপাকে পড়েছে। এছাড়া হ্যাচারী কমিটির সদস্যদের স্বেচ্ছাচারীতা ও হেঁয়ালিপনার কারণে হ্যাচারীতে রাখা অনেক রেণু নষ্ট হয়ে বলে এ প্রতিবেদককে এমনটা জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ মুমিনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারি হ্যাচারিগুলো চালাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে প্রকল্প ছিল। তখন প্রকল্পের ফান্ড দিয়ে এগুলো সংস্কার ও লোকবল রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন কোনো প্রকল্প নেই। তাই এগুলো সংস্কার ও লোকবল রাখা যাচ্ছে না। হ্যাচারিগুলো সংস্কারে বাজেট চাওয়া হয়েছিল। নানা কারণে অর্থ বরাদ্দ মেলেনি। তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। তারপরও স্থানীয়ভাবে এগুলো সংস্কার করে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।উল্লেখ্য, বিগত ১০ বছরের পুরানো রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বৃষ্টি ও মেঘের সামান্য গর্জনের ফলে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে নদীতে সৃষ্ট স্রোতে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা-মাছ। বছর পর হাসি ফুটেছে হালদায় মা মাছের ডিম সংগ্রহকারীদের মুখে। গত বছর ডিম সংগ্রহ হয়েছিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি। এবার সংগ্রহ হয়েছে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন হবে প্রায় ৩৭৮ কেজি। ওই উৎপাদিত এক কেজি রেণুতে চার-পাঁচ লাখ পোনা হবে। পরিমাণমতো পানিসহ এক কেজি রেণু গত বছর সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। এ হিসাবে এবার যে ডিম হয়েছে চার দিন পর সেগুলোর দাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিষেজ্ঞরা।