সেনাবাহিনী ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয় মনে করেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে করতে গেলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে।সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আসন্ন ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এ বৈঠক আয়োজন করে। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন বাসদের খালিকুজ্জামান, সুজনের জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, বিএনপির রুমিন ফারহানা এবং বিধান চন্দ্র পাল। আলোচনা শেষে ‘নগরায়ণ ও নগর সরকার’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। বইটির লেখক স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, সহলেখক বিধান চন্দ্র পাল।।

অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেছেন, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন কমিশনকে সজাগ ও সতর্ক হতে হবে। কারণ তারা ঘুমিয়ে আছে।হাফিজউদ্দিন খান বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন চিন্তা ভাবনার কথা বলেছিল। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত। নির্বাচন কমিশন এ বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করেনি, এটা দুঃখের বিষয়। কারণ নির্বাচন সুষ্ঠু করা কমিশনের দায়িত্ব। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যা যা করা দরকার কমিশন তাই করবে এটা আমরা আশা করি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সেনাবাহিনী ছাড়া সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না জানি না। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেনবাহিনী ছাড়া হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থান নেয়। বিরোধী দলে থাকলে তারা সেনাবাহিনী চায়। অথচ ২০০৩ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ সাঈদ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিএনপি দেয়নি। নির্বাচন আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে চাইলে তা দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন।সাখাওয়াত কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী চেয়েও সরকারের কাছ থেকে তা পায়নি ইসি। তবে সেই ভোটে গোলযোগ হয়নি।তার আগে ২০০৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার পূর্বসূরিরাও সেনাবাহিনী চেয়ে তা না পাওয়ায় কী হয়েছিল, গোলটেবিলে তা তুলে ধরেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত।তিনি বলেন, সেই সময় সিইসি ছিলেন আবু সাঈদ। তিনি নির্বাচনে এক মাস ধরে তৎকালীন সরকারকে বলে আসছিলেন, আমার প্রয়োজন আছে সেনাবাহিনী দেবেন। সরকার সেনাবাহিনী দেয়নি। ওই সময় সরকারে ছিল বিএনপি। সেই নির্বাচন রক্তাক্ত নির্বাচন হয়েছিল, পত্রপত্রিকায়ও লেখা হয়। এমনকি সিইসি বলেছিলেন, এই ইলেকশনে রক্তপাত হবে, সেটার জন্য দায়ী থাকবে সরকার। পার্লামেন্টে ওনাকে ইমপিচ করার জন্য অনেক সদস্য দাঁড়িয়ে যান। এরপর এই নির্বাচন হল, এতে ১১৭ জন লোক মারা গেল। জিনজিরার এখানে একজন মানুষকে টুকরা টুকরা করা হল।

সংসদ নির্বাচন হোক কিংবা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন, সেখানে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হবে কি না, তা সম্পূর্ণ ইসির উপর নির্ভর করে বলে মনে করেন সাখাওয়াত। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের বাদানুবাদ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।আমি জানি না, সেনাবাহিনী নিয়ে বিরোধী দল বা সরকারে যারা থাকে, তাদের কী সমস্যা। নির্বাচন কমিশনকে নিরাপত্তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হয়। একটি নির্বাচনের নিরাপত্তাজনিত কাজে ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয়, বাকি টাকা অন্যান্য কাজে খরচ হয়। তাই সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন পড়ে।আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠেয় খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি তুলেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সেনা মোতায়েন হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ইসির নেই।

সাখাওয়াত বলেন, সরকার চাইলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিরপেক্ষ করা সহজ।এখন একটা রীতি হয়ে গেছে, আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, এটা হবেই। এটাকে রুখতে হলে দিনের বেলা ব্যালট পেপার বিতরণ করতে হবে। সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে ব্যালট পেপার কেন্দ্রে দিতে হবে। এরপর ৯টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু করে বিকাল ৫টায় শেষ করতে হবে।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান গোলটেবিলে বলেন, এই নির্বাচনে (খুলনা-গাজীপুর) সেনা মোতায়েনে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন থেকে এই বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি, সম্ভবনাও দেখা যাচ্ছে না। যদিও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে সরকারকে দিতে হবে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণায় সুযোগ না দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন,আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি’ শাসিত সরকারের আদলে পরিচালিত। এ ব্যবস্থার সংস্কার করে তৃণমূল সংসদীয় পদ্ধতির স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।পাঁচ বছর ধরে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ব্যয়বহুল এবং এরফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয় বলে মন্তব্য করেন এই অধ্যাপক। এসব স্থানীয় নির্বাচন এক তফসিলে করার পক্ষে মত দেন তিনি।গোলটেবিলে বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে এখন স্থানীয় সরকার বলা বেমানান, এটা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্প্রসারিত অংশ। স্থানীয় সরকারকে তার নিজস্ব রূপে নেওয়া জরুরি।প্রার্থীদের হলফনামায় মিথ্যা তথ্য ও অনুপার্জিত সম্পত্তি পাওয়া গেলে প্রার্থিতা বাতিলের পাশাপাশি ওই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে আইন করার দাবি জানান তিনি।

হাই কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও নির্বাচিতরা স্বাধীনেভাবে কাজ করতে পারেন না। রাজশাহী ও গাজীপুরের নির্বাচিত মেয়রদের দিতে তাকালেই বোঝা যায়।বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা বলেন, মানুষ নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন কেউ ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে চায় না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ। ভোটাররা আগে অনুমান করতে পারে কে নির্বাচনে জিতবে।সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখন মানুষ ধরেই নেয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এই দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে।