মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি এবং সেনাপ্রধান মিং অন হ্লাং-এর সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছে সফররত জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল। সোমবার মিয়ানমারে পৌঁছানোর পর নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ দলটি ডি-ফ্যাক্টো সরকারের শীর্ষ দুই প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সু চি আবারও মিয়ানমারে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের কাছে ‘আরও বেশি করে’ সহযোগিতা প্রার্থনা করেছেন।

মিয়ানমার টাইমস লিখেছে, সন্ত্রাসী হামলার কারণ দেখিয়ে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো যে অভিযানে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া হয়েছে, সেই অভিযানের ফলাফল স্বচক্ষে দেখতে রাখাইনে যাবে প্রতিনিধি দল। ফিরে যাওয়ার জন্য মিয়ানমারের পরিবেশ রোহিঙ্গাদের অনুকূল কি না তাও তারা সরেজমিনে দেখতে চান।

মঙ্গলবারে রাখাইন পরিদর্শনের আগে সোমবার নেপিদোতে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে দীর্ঘ এক ঘণ্টা বৈঠক করেছেন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি। সু চির সঙ্গে তাদের ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজধানী নেপিডোতে। বৈঠকে যে কোনও ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ তদন্তের ব্যাপারে তার সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সু চি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপস্থিত একজন কূটনীতিক জানিয়েছেন, দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের অধীনে থেকে এখন গণতন্ত্রের ধারায় ফেরত যেতে দেশটির সমস্যা হওয়ার কথা জানিয়েছেন সু চি।সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট লিখেছে, ‘প্রত্যায়িত’ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নিয়ে যাওয়ার বিষয়েও সু চি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বৈঠকে সু চি দাবি করেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের কাছে থেকে আরও বেশি সহযোগিতা প্রত্যাশা করছেন তিনি। একইসঙ্গে আবারও মিয়ানমারে যে কোনও সময় সহিংসতা শুরুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের এই রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা। এরইমধ্যে প্রতিনিধি দলটির রাখাইনের দুইটি গ্রাম পরিদর্শনের খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইন উপযুক্ত কিনা, পরিদর্শনকৃত ওই দুই গ্রামের অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই তারা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাবেন। মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনেই তাদের অবস্থান জানা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ১৯৮২ সাল থেকে প্রায় সব রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। যার ফলে রোহিঙ্গারা কার্যত দেশহীন মানুষে পরিণত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কার্যনির্বাহি পরিচালক কেনেথ রথ বলেছিলেন, ‘মানবতা বিরোধী যে অপরাধগুলো করা হয়েছে সেগুলো এতটাই গুরুতর ও প্রকট যে নিশ্চিতভাবেই সেগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিচার্য। যদি দায়মুক্তি দেওয়া হয় তাহলে তা ভুক্তভোগীদের ও তাদের পরিবারগুলোর প্রতি অনেক বড় অবিচার করা হবে এবং তা একই রকম নিপীড়ন পুনরায় ঘটাকে উৎসাহিত করবে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য শর্ত হিসেবে চাওয়া হয়েছে বৈধ কাগজপত্র। অথচ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পুড়ে যাওয়া সম্বল ফেলে পালিয়ে এসেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রত্যাবাসন চুক্তিকে মিয়ানমারের ধোঁকাবাজি আখ্যা দিয়েছে। এএফপির সাবেক সাংবাদিক লিউক হান্ট কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলেন, ৮ হাজার পরিবারের নাম মিয়ানমারের কাছে দেওয়া হয়েছ। তবে সেখান থেকে মাত্র ৬০০ জনকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার।স্টার অনলাইনের প্রতিবেদনে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালে হত্যাযজ্ঞের পর পালিয়ে এসেছিলো প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। এক চুক্তির মাধ্যমে সবাইকে ফেরত পাঠানো হলেও ১৯৯১-৯২ সালে আবারও পালিয়ে বাংলাদেশে আসে ২ লাখ ৫০ জন। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়। তবে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরতে পারেনি। এরই মধ্যে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল আরও তিন লাখসহ গত বছরের আগস্ট থেকে পালিয়ে আসাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৯ লাখে। অধ্যাপক আবরার বলেছেন, মিয়ানমার সত্যিই তাদের ফেরত নিতে চাইলে আরও বিস্তারিত প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত ছিল। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরও চুক্তির আগেই বলেছিলেন, সমঝোতায় যখন বিস্তারিত কিছু থাকে না তখন আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। তিনি সে সময় বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাখাইনে অনুকূল পরিস্থিতি। কিন্তু সেটা নিশ্চিতে কার্যত কোনও পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।