ডাক,টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যদি না থাকে, তাহলে সংবাদপত্রের ভিত্তিটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। আমরা সংবাদপত্রের কাছ থেকে সেই ভিত্তিটা চাই। আমরা চাই যে, কোথাও দুর্নীতি হলে, অপরাধ হলে, অনিয়ম হলে মিডিয়া তা তুলে ধরুক। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে। সেই স্বাধীনতা খর্ব হবে, এমন কোনও আইনে আমরা যাবো না। বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যমের বর্তমান চিত্র’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের এটুকু আশ্বস্ত করতে পারিÑ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ক্ষেত্রেও তা করা হবে। জনগণের মতামতের বাইরে আমার মনে হয় না কোনও আইনকে চূড়ান্তভাবে পাস করতে পারবো। আসলে মিডিয়া জগতের বাইরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। নিরাপদ ইন্টারনেটের জন্য আইনের দরকার আছে। আমরা অবশ্যই সবার সঙ্গে বসবো ধারাগুলো নিয়ে। লাইন বাই লাইন বসে আলোচনা করবো। বিশেষ করে ৩২ ধারায় গুপ্তচর বৃত্তির কথা উল্লেখ আছে। আইনমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বলেছেন গুপ্তচর বৃত্তি এবং সাংবাদিকতা এক জিনিস না। সাংবাদিকতাকে আমরা কখনও গুপ্তচর বৃত্তির ছকের মধ্যে ফেলতে পারি না।

ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই হেনস্থার শিকার হন দাবি করে মন্ত্রী বলেন, সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই হেনস্থার শিকার হন, এমনকি সাংবাদিকরাও বাদ পড়েন না। আপনারা খুব অবাক হবেন শুনলে যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত, এমন বোধহয় কেউ বাদ পরেনি যাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য, মিথ্যাচার এমনকি ট্রল করাও হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের সমাজের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ হচ্ছে নারী এবং শিশু।আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যে, আমরা যদি তাদেরকে নিরাপদ করতে না পারি, তাহলে তাদেরকে ইন্টারনেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। আমাদের জন্য এটিও চ্যালেঞ্জ, কাউকে ইন্টারনেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না।

প্রযুক্তি দিয়ে প্রশ্নফাঁসের মোকাবিলা করা হয়েছে উলে¬খ করে মন্ত্রী বলেন, প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি আমাদের জাতীয় আলোচনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশ্নফাঁস কিন্তু কোনও দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়া, কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া করেনি, যেটি প্রচার করেছে সেটা ফেসবুকে। সেক্ষেত্রে একসময় তো আমার ওপর চাপই ছিল ফেসবুক বন্ধ করার। নির্দেশ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল ফেসবুক বন্ধ করার। আমরা হিসাব করে দেখেছি, মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা উচিত না। আমাদেরকে এটিকে মোকাবিলা করতে হবে। আজকে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন প্রশ্নফাঁস করা হয়েছে, তেমনি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা ১৫০ জন প্রশ্নফাঁসকারীকে ধরতে পেরেছি।প্রজুক্তিগত অপরাধ মোকাবিলায় আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে মোস্তাফা জব্বার বলেন, প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একজন মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, আইনের কাঠামো দরকার। প্রযুক্তিগত অপরাধ মোকাবিলার জন্য প্রযুক্তির প্রয়োজন আছে। এই জায়গায় সরকার অত্যন্ত সচেতন। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কতগুলো ধারা সম্পর্কে এখানে বলা হচ্ছে, এই আইন বাস্তবায়নে সরকারের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা সম্পর্কে অবগত করতে চাই। দীর্ঘদিন ধরে এই আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আলোচনার মধ্য দিয়ে খসড়াটি চূড়ান্তরূপে মন্ত্রিসভায় গেছে এবং তারপর সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। এই সময়েই কিন্তু আমরা বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই প্রতিক্রিয়াগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে আমরা দেখছি। কিন্তু পাশাপাশি এখন সেই আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। চূড়ান্তপর্যায়ে থাকার মানে হচ্ছে,এই আইনটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আছে। ইতোমধ্যে কমিটিতে এই আইনটি নিয়ে একটি সভা হয়েছে এবং সেই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছেÑ যেসব ধারা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট করে আলোচনা করবো।মিডিয়ার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে আইন নিয়ে আলোচনা করা হবে উলে¬খ করে তিনি বলেন, আমাদের পরবর্তী যে স্থায়ী কমিটির সভা থাকবে, সেই সভাতে যেন মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে, তা আমরা নিশ্চিত করবো। আমরা ইতোমধ্যে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে কথা বলেছি, সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আপনারা অনুগ্রহ করে লিখিতভাবে বক্তব্য দেন। সেই লিখিত বক্তব্য আমরা স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপন করবো। স্থায়ী কমিটির বিবেচনা সাপেক্ষে এটি আবার সংসদে যাবে। সংসদে গিয়ে এটি আবার সংসদ সদস্যদের আলোচনার আওতায় পড়বে। সুতরাং আমাদের সংশোধনের জায়গাটা অনেকাংশে রয়ে গেছে। একটি জিনিস সবাইকে মাথায় রাখতে হবে যে, ডিজিটাল অপরাধ দমন করা শুধুমাত্র সরকারের দায়িত্ব না, এই দায়িত্ব সাংবাদিকসহ এদেশের জনগণের। ডিজিটাল যুগে মানুষ যাতে নিরাপদে বসবাস করে, সেটি নিশ্চিত করাও কিন্তু আমাদের সবার দায়িত্ব।

তিনি আরও বলেন,ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মানহানির ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান বেশি রাখা হয়েছে কেন, এই বিষয়টি আপনাদের বুঝতে হবে। আমি যখন এই কক্ষের মধ্যে কাউকে গালি দিচ্ছি, সেটা সীমাবদ্ধ থাকছে কয়েকজনের মধ্যে। কিন্তু আমার সেই বক্তব্যটাকে যদি ফেসবুকে লাইভ করি, তাহলে মুহূর্তেই কয়েক লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।স্বাভাবিকভাবেই আমরাযে অপরাধটি করছি, আর ডিজিটাল অপরাধটি করছি, তার পরিমাপ এক না। আমাদের ডিজিটাল অপরাধের মাত্রাটিকে বুঝতে হবে। এই কারণে আমরা না আপনারাই সুপারিশ করবেন, কেউ কাউকে সামনাসামনি গালাগালি করলে তার শাস্তি কী হবে, আর ফেসবুকে যখন এককোটি মানুষের কাছে তার গালি পৌঁছাবে, তখন তার শাস্তি কী হওয়া উচিত। এটিকে আমরা এতদিন শারীরিক আঘাত হিসেবে মনে করে আসছি। আমার ঘর থেকে কেউ যদি সোনার গয়না চুরি করে নিয়ে যায়, তাহলে আমার কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে। কিন্তু আমার হার্ডডিস্ক যদি কেউ পুড়িয়ে ফেলে, আমার তথ্য চুরি করে, তাহলে আমার সোনার গয়নার চেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন হবে।আজকের জায়গায় আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য কে কীভাবে ব্যবহার করছে, সেই জায়গা আমাদের জানা নেই।পৃথিবীতে বহু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা কেবল ডাটা নিয়ে ব্যবসা করে। খুব সম্প্রতি আপনারা দেখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনসহ অন্যান্য জায়গায় কিন্তু ডাটা ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও কিন্তু এসেছে। আমাদের জন্য এইটা আরও চ্যালেঞ্জিং। এটা নির্বাচনের বছর।এই নির্বাচনকে যদি আমরা নিরপেক্ষ করতে চাই, আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, আমরা ফেসবুককে কীভাবে ব্যবহার করবো। এই সরকার আমাদের সবার সরকার। এই সরকার সবার কথা শোনে। সবার পরামর্শ নিয়ে, সবার মতামত নিয়ে তারপর আইন প্রণয়ন করবে। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শ্যামল দত্ত, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, এমআরডিআই’র নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান, প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তানজিব-উল আলম।