গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (জিসিসি) এবারের নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে। প্রতিদিনই প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সকাল হতে রাত পর্যন্ত ব্যাপক উৎসব মুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বসে নেই তাদের আত্মীয় স্বজনরাও। তারা শহরের অলিগলি, হাট-বাজার, দোকান, মিল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠাণসহ প্রতিটি এলাকা ঘুরে ঘুরে ভোটারদের কাছে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীদের সহযোগিতা করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্ততঃ ডজন খানেক কেন্দ্রিয় নেতা প্রতিদিন গাজীপুরে আসছেন গণসংযোগ করতে। এ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় সংসদসহ আগামি নির্বাচনগুলোতে অনেকটা প্রভাব ফেলবে এমন ধারনায় এ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ১৪দলীয় ও ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা প্রতিদিন গাজীপুরে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা গ্রামে বা হাট-বাজারে গিয়ে খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছেন ও একত্রে ঘুরছেন, এমন কি ছোট দোকানের বেঞ্চে বসে চা’ পান করছেন। নির্বাচনের কারণে হলেও যেন এসব ভিআইপি নেতাদের কাছে শ্রমিক ও সাধারন মানুষের কিছুটা সময়ের জন্য কদর বেড়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের পদচারনায় গাজীপুরের শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে। গাজীপুরের বাইরের অন্য এলাকা থেকে এখানে এসে বিভিন্ন মিল-কারখানায় ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এবং ভোটার হয়েছেন এমন ভাসমান ভোটারদের ভোটে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ভাগ্য অনেকটা নির্ধারিত হবে। তারাই এখন এ নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর। তাই প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা প্রতিদিন এসব ভাসমান ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে তাদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন সমর্থন ও ভোট আদায়ের জন্য। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে ৭জন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম (নৌকা) ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের (ধানের শীষ) মধ্যে ভোটযুদ্ধের লড়াই চোখে পড়ার মতো। সকলের আলোচনার কেন্দ্র এখন এ দু’প্রার্থীকে ঘিরে।

্এদিকে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও সেবা দানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করাসহ ১৯ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী আলহাজ্ব হাসান উদ্দিন সরকার। ইশতেহারে তিনি দুর্ণীতি দূর করতে প্রযুক্তিগত পদ্ধতি প্রণয়ন, শিক্ষার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবা ও নিরাপদ খাদ্য, আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন, নাগরিক নিরাপত্তা প্রদান, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নেরও প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়াও তিনি বিজয়ী হলে দেশি-বিদেশি নগর বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে নগরায়নের মাস্টার প্লান প্রণয়ন করবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের সমস্যা চিহ্নিত করতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ‘নাগরিক উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করবেন বলে ঘোষণা দেন। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি টঙ্গীতে আউচ পাড়ার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই ইশতেহার ঘোষণা করেন।

অপরদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মেয়র প্রার্থী, নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. মাহবুব তালুকদার। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে ওই সভায় অন্যান্যের মধ্যে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মন্ডল, নির্বাচন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মিজানুর রহমান, গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, আওয়ামীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী ফজলুর রহমান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী কাজী মো. রুহুল আমীন, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট প্রার্থী মো. জালাল উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মো. নাসির উদ্দিন, স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ এবং বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহবুবুল হক গোলাপ প্রমূখ বক্তব্য রাখেন। এছাড়া নির্বাচন সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তা, বিজিবি কর্মকর্তা, আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তা, ফয়ার সার্ভিস, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। সভায় প্রধান অতিথি বলেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি, তারপরও যদি কেউ তা অমান্য করেন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রার্থীদের গণসংযোগ ঃ
আওয়ামীলীগ ॥ আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বৃহস্পতিবার সকালে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের ছয়দানা সড়ক এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারণা শুরু করেন। দুপুরে তিনি গাজীপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মেয়র প্রার্থী, নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। সভায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বি একটি দলের হয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসী, হত্যা মামলার আসামী এবং দূর্বৃত্ত্বদের এনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করছে। এরপর বিকেলে তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টির মধ্য দিয়ে ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে টঙ্গীর মধুমিতা এলাকা হতে নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারণা শুরু করেন। তারা সেখানে পৌছলে সহ¯্রাধিক নেতা-কর্মী-সমর্থক তাদেরকে অভ্যর্থনা জানায়। পরে অধিকাংশরাই বৃষ্টিতে ভিজে গণসংযোগে অংশ নেন। তারা ৪৫ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধুমিতা রেল গেট, বউ বাজার, জামাইবাজার, বিসিক, মিরাশপাড়া, নদী বন্দর, সালামের আটার কল, টঙ্গী রেল স্টেশন, নতুন বাজার, গাজী বাড়ি, সেনা কল্যাণ মোড় ও টঙ্গীবাজার এলাকায় গণসংযোগ করেন। পূর্ব আরিচপুর জামাই বাজারে অনুষ্ঠিত পথসভায় আজমত উল্লাহ খান বলেন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর সাথে সাথে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি সুশীল সমাজের অধিকাংশ সংগঠন নৌকার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আগামী ১৫ মে নৌকা মার্কা ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করবে। জাহাঙ্গীর বলেন, আজমত ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের সুসংগঠিত প্রচারণার ফলে মহানগরের ঘরে ঘরে নৌকার রব উঠেছে। গাজীপুরকে গ্রীণ ও ক্লিন সিটিতে পরিনত করতে আমি আগামী ১৫ মে নৌকা মার্কায় আপনাদের ভোট চাই।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মতিউর রহমান মতি, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী ইলিয়াস আহমেদ, টঙ্গী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ফজলুল হক ও সাধারন সম্পাদক মো. রজব আলী, কাউন্সিলর মো. আবুল হোসেন, ন্যাশনাল টিউবস সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন আমু, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান মন্ডল, তাঁতী লীগ সভাপতি মো. শাহ আলম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বৃহষ্পতিবার বিকেলে কর্মী সমর্থকদের নিয়ে বোর্ডবাজার, গাছা বাজার, চান্দরা মাদ্রাসা, মির্জা ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্কুল ও আয়েত আলী কিন্ডার হার্টেন এলাকায় গণসংযোগ করেন। এর আগে সকালে তিনি তার বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলণে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।

অপপ্রচার ঠেকাতে হাসান সরকারের অভিযোগ
গাজীপুরে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের শাহাদাৎ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে শুধুমাত্র তাঁর মাজার ও পারিবারিক গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা নিতে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারকে অনুরোধ জানিয়েছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার।

এ ব্যাপারে তিনি বুধবার তিনি রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত একটি অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি শহীদ আহসান উল্লাহ মাষ্টারকে তার এক সময়ে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মী বলে উল্লেখ করেন। তিনি আহসান উল্লাহ মাষ্টারের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও প্রকৃত খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, ভোটারদের প্রলোভন ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে শহীদ আহসান উল্লাহ মাষ্টারের শাহদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষ করে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং তার পক্ষে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে স্মরণসভা, গণভোজ, কাঙ্গালীভোজ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি নামে নির্বাচনী শো ডাউন ও তাঁকে (হাসান উদ্দিন সরকার) জড়িয়ে অপপ্রচারের আয়োজন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রতিটি ওয়ার্ডে গরু কেনার জন্য টাকাও দিয়েছেন বলে তিনি পরষ্পর শুনতে পেরেছেন। যা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান অধিকারকে মারাত্বকভাবে খর্ব করবে। তাই তিনি গাজীপুরে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের শাহাদাৎ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে শুধুমাত্র তাঁর মাজার ও পারিবারিক গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মন্ডল জানান, বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত আসলে পরে তা জানানো হবে।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ৭ মে জাতীয় শ্রমিকলীগ নেতা ও গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাষ্টার তাঁর বাড়ির কাছে নোয়াগাঁও হাইস্কুল মাঠে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক সম্মেলনে দূর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। এরপর থেকে প্রতিবছর ৭ মে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁর শাহাদাৎ বার্ষিকী পালিত হয়ে আসছে।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের ইশতেহার ঘোষণা
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মো. হাসান উদ্দিন সরকার বৃহস্পতিবার সকালে তার ১৯দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। সকাল ১০টার দিকে তার টঙ্গী বাসভবনে ওই ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। এসময় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি’র নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক একেএম ফজলুল হক মিলন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দস তালুকদার দুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়্যেদুল আলম বাবুল, নির্বাহী সদস্য এমএ মতিন, কন্দ্রীয় সদস্য ডা. মাজহারুল আলম, ওলামাদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মাওলানা পীরজাদা রুহুল আমিন, মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী খায়রুল আলম, জাগপার মহানগরীর সভাপতি প্রিন্সিপাল হুমায়ুন কবির, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম জেলা সভাপতি মুফতী নাসির উদ্দিন, লেবার পার্টির মহানগরীর সভাপতি আহসান হাবীব ইমরুজ, জেলা যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সবুজ, পেশাজীবী জেলা সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, প্রভাষক বসীর উদ্দিন প্রমূখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

১৯ দফা ইশতেহার:
নগরায়নের মাস্টার প্লান প্রণয়ন ॥ দেশী-বিদেশী নগর বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে এই প্লান প্রণয়ন করা হবে এবং এরই ভিত্তিতে সকল উন্নয়ন কার্মকান্ড পরিচালিত হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডের সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ‘নাগরিক উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে নাগরিকদের মতামত নেওয়া হবে।
নগরভবন নির্মাণ ॥ গাজীপুর পৌরসভার পুরোনো ভবনে স্বল্প পরিসরে এখনো চালাতে সিটি কর্পোরেশনের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এজন্য বিশে^র সেরা নগরভবনগুলোর সাথে মিল রেখে প্রখ্যাত স্থাপত্যবিদ এবং পরিকল্পনাবিদদের তত্বাবধানে নির্মিত হবে গাজীপরের ‘নগরভবন’।

সেবা দানকারী অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় ॥ পুলিশ, সড়ক ও জনপথ, ডেসকো, পল্লী বিদ্য্ৎু, টি এন্ড টি, ইত্যাদি সেবাদানকারী সংস্থার সঙ্গে সুষম সমন্বয় করে সর্বোচ্চ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করব।

দুর্নীতি দরীকরণ ও স্বচ্ছতা ॥ আমি বিজয়ী হলে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সব ধরণের সেবা দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ করব। দুর্নীতির সঙ্গে আমি কোনো আপোস করবো না। দুর্নীতি বন্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করব। নাগরিকদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটিকে পেশীশক্তি, মাস্তানি, টেন্ডারবাজিসহ সকল অনৈতিক প্রভাববলয় থেকে মুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। সকল দরপত্রের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

শিক্ষা ॥ শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়নের লক্ষে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাগুলোকে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় সম্পৃক্ত করে উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করবো। ভোকেশনাল, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ করে বেকার সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতিম ও দুঃস্থ, গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করে স্বল্প আয়ের মানুষের সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করবো। নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে বেকার যুবক-যুবতীদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজ উন্নয়নে সম্পৃক্ত করবো। প্রত্যেক এলাকায় গণপাঠাগার স্থাপন করা হবে।

খাদ্য সেবা ও নিরাপদ খাদ্য ॥ ‘আরবান হেলথ কেয়ার সেন্টার’ বা ‘নগর স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের এবং বস্তিবাসী নাগরিকদের জন্য সুলভে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকে অনলাইন সেবার আওতায় আনা হবে। ‘অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা’র ওপর ভিত্তি করে কলকারখানার দূষণ কার্যক্রম পরিশীলিতকরণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজকে যথাযথকরণ এবং দূষণকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আবাসন ব্যবস্থা ॥ গার্মেন্টস শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের জন্য সু-পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প করা হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য পর্যায়ক্রমে স্বল্পমূল্যের বাসস্থান নির্মাণ করা হবে।
নিরাপত্তা ॥ নগরীতে সিসি ক্যামেরা, কমিউনিটি পুলিশ ও নৈশ প্রহরী নিয়োগ করে নগরবাসীকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে সু-সম্পক তৈরি করে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

যাতায়ত ॥ সব সড়ক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলাচল উপযোগী করা হবে এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে পুরানো রাস্তার সংস্কার ও নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হবে।

যানজট ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ॥ টঙ্গী বাজার থেকে শুরু করে জয়দেবপুর চৌরাস্তা হয়ে কোণাবাড়ি পর্যন্ত ভয়াবহ যানজটে নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্ত নেই। যানজট নিরসনের কাজটি মূলত ট্রাফিক বিভাগের। তারপরেও সমন্বিত উদ্দ্যোগের মাধ্যমে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা তৈরি করে গাজীপুরকে সচল ও গতিময় রাখা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। যানজট নিরসনে নিরাপদ ও পরিকল্পিত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

নগরীর পরিচ্ছন্নতা ॥ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন জায়গায় (স্কুল, কলেজ, বাসস্ট্যান্ড, বাজার, ইত্যাদি পয়েন্টের কাছাকাছি) আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে। ফুলের বাগান পরিবেষ্টিত এসব গণশৌচাগারে থাকবে- নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কক্ষ, লকার ব্যবস্থা, হাত ধোয়ার জন্য সাবান, পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ, গোসলের ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং প্রশিক্ষিত পেশাদার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও কেয়ারটেকার। সূর্যোদয়ের পূর্বেই সড়কের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শেষ করা হবে। সড়কে ও সড়কের পার্শ্বস্থ বৃক্ষরাজিতে জল সিঞ্চনের মাধ্যমে ধুলা-বালি নিয়ন্ত্রণ এবং সব ধরণের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমকে আধুনিকীকরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ॥ নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞ ও দাতাদের সহায়তা নেয়া হবে। এলাকাভিত্তিক ময়লা সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। বর্জ্য রিসাইকেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও সারের মতো সম্পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্জ্য সংগ্রহ পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত থেকে আচ্ছাদিত পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়া হবে।

সবুজ ও পরিবেশ বান্ধব নগরায়ন ॥ পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানগুলোকে ঘিরে পরিকল্পিত বৃক্ষায়নের মাধ্যমে সবুজায়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবো। বাসা-বাড়ি নির্মাণ এবং নগর পরিকল্পনায় সবুজকে প্রাধান্য দেয়া হবে। সবুজ গাজীপুর গড়ে তুলতে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পিত বনায়ন করা হবে। নগর পরিকল্পনায় পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। শব্দদুূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে।

জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ॥ এলাকাভিত্তিক জলাবদ্ধতা দূরীকরণে স্থানীয় জনগণ এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ॥ ৫৭টি ওয়ার্ডেই বিদ্যমান গভীর নলকুপগুলো সচল রাখতে ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক গভীর নলকুপ স্থাপন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট গড়ে তুলে ব্যবহৃত পানি যেন পরিবেশ দূষণের কারণ না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহ ॥ নগরবাসীর জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সিটি কর্পোরেশনের সব কয়টি ওয়ার্ডে পল্লী বিদ্যুতের পরিবর্তে ডেসার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেসব এলাকায় গ্যাস লাইন নেই সেসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ লাইন স্থাপনের জন্য যথাযথ কতৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালাবো।

ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিনোদন ॥ নগরের ভেতর পার্ক, মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান চিহ্নিত করা হবে। খেলাধুলা ও শরীরচর্চার উপযোগী করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পার্ক ও মাঠ নির্মাণ করা হবে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে গণগ্রন্থাগার (লাইব্রেরি) স্থাপন ছাড়াও বিশেষ বিশেষ জায়গায় আরও কয়েকটি আধুনিক ডিজিটাল লাইব্রেরি চাল করার ব্যবস্থা করবো। বঙ্গতাজ অডিটোরিয়াম ও টঙ্গী অডিটোরিয়ামকে ব্যবহার উপযোগী ও আরো আধুনিক করে গড়ে তুলবো। তরুণদের জন্য আধুনিক স্বাস্থ্য ও ক্রীড়াকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।

নাগরিক সেবা আধুনিকীকরণ ॥ নাগরিক সেবা, অভিযোগ ও সমস্যা সমাধানে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চাল করা হবে। মাসে অন্তত নির্দিষ্ট একদিন মেয়রকে সরাসরি ফোন করে নগরবাসী তাদের অভিযোগ, পরামর্শ ও মতামত জানাতে পারবে। নগরবাসীকে প্রতিটি সেবার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়ার জন্য একটি ‘নগর তথ্য কেন্দ্র’ খোলা হবে। নাগরিকদের সুবিধার্থে অফিসিয়াল সকল কার্যক্রম অনলাইন ভিত্তিক পরিচালনা ও অনলাইন আবেদনের সুবিধার্থে এলাকাভিত্তিক ফ্রি ইন্টারনেট (ওয়াইফাই) এর ব্যবস্থা করবো।

অন্যান্য কর্মসূচী ॥ অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে গাজীপুরবাসীর ঝাপিয়ে পড়ার দিবসটি (১৯ মার্চ) যথাযথ মর্যাদায় যেন পালিত হয় সে ব্যবস্থা করা হবে। এই যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের নামে গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীকে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যাক্তি কিম্বা প্রতিষ্ঠানকে বৃত্তি প্রদান করা হবে।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ধর্মের নাগরিকদের সমাহিত করার জন্য পর্যাপ্ত কবরস্থান ও শ্মশান গড়ে তুলে তাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী, মনোরম ফুলের বাগান, বৃক্ষরোপণসহ যার যার ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করা হবে। লাশবাহী পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা হবে। সাংবাদিকদের উন্নয়নে তাদের প্রেসক্লাবকে আধুনিক প্রষ্ঠিানে পরিণত করা হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, গাজীপুর ও নুরুল ইসলাম, টঙ্গী ॥