আইনি জটিলতা শেষে চার বছরের বেশি সময় ধরে হিমঘরে সংরক্ষনে থাকা ধর্মান্তরিত নীলফামারীর ডোমার উপজেলার হোসনে আরা ইসলাম (২০) নামের এক কলেজ ছাত্রী নববধুর মরদেহ ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী শুক্রবার বেলা তিনটায় নীলফামারী জেলা প্রশাসকের নিয়োগকৃত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: উম্মে ফাতিমা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মেয়েটির শ্বশুরবাড়ি উপজেলার বোড়াগাড়ি ইউনিয়নের পূর্ব বোড়াগাড়ি কাজীপাড়া কবরস্থান চত্বরে দুই দফা নামাজে জানাজা শেষে তার স্বামী হুমায়ুন ফরিদ লাইজুর কবরের পাশে দাফন সম্পন্ন করা হয়।জানাজায় হাজার হাজার মুসল্লি অংশ নিতে আসায় স্থানসংকুলের কারনে দুই দফায় জানাজা করা হয়। প্রথম জানাজাটির ঈমামতি করেন হোসনে আরার দাদা শ্বশুড় কাজী আব্দুল জলিল ও দ্বিতীয় জানাজার ঈমামতি করেন কাজি পাড়া জামে মসজিদের ইমাম মওলানা রবিউল রহমান।
চলতি বছরের গত ১২ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ধর্মান্তরিত হোসনে আরা ইসলামকে মুসলিম রিতি অনুযায়ী দাফন করার আদেশ দেন। এ রায়েই শুক্রবার বিকালে কার্যকর করা হয় বলে জানান দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট উম্মে ফাতিমা।
এর আগে গত বৃহ¯পতিবার (৩ মে) হাইকোটের ওই আদেশের কপি জেলা প্রশাসকের হাতে পৌছে। আদালতের আদেশ মোতাবেক জেলা প্রশাসকের পক্ষে সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করে শুক্রবার সকাল সোয়া ১১টায় রংপুর মেডিকেল কলেজের হিমঘরে সংরক্ষনে থাকা হোসনে আরার মরদেহ নিয়ে আসা হয় একই উপজেলার বোড়াগাড়ি ইউনিয়নের পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের কাজিপাড়া এলাকার মেয়েটির শ্বশুড় সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলামের বাড়িতে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরনীতে জানা যায়, ডোমার উপজেলার খামার বমুনিয়া গ্রামের অক্ষয় কুমার রায়ের মেয়ে কলেজছাত্রী নিপা রানী রায়ের সঙ্গে একই উপজেলার বোড়াগাড়ি ইউনিয়ন পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ুন ফরিদ লাইজু ইসলামের প্রেমের স¤র্পক ছিল। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক মোছা. হোসনে আরা ইসলাম নাম ধারণ এবং দুই লাখ ১ হাজার ৫০১ টাকা দেনমোহরে হুমায়ুন ফরিদ লাইজু ইসলামকে বিয়ে করে।
এ অবস্থায় মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর বাদী হয়ে নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে শারীরিক পরীক্ষার জন্য মেয়েটিকে রাজশাহী সেফহোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি মেয়েটির স্বামী হুমায়ূন ফরিদ লাইজু ইসলাম বিষপান করে আত্মহত্যা করে। এরপর মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার তার মেয়েকে নিজ জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে রাখেন। তবে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের ১০ মার্চ দুপুরে বাবার বাড়িতে কীটনাশক পান করে মেয়েটি। তাকে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে মারা যায়। পুলিশ হাসপাতাল হতে মেয়েটির লাশ রাতেই উদ্ধার করে পরের দিন জেলার মর্গে ময়না তদন্ত করে। কিন্তু সমস্যা সৃস্টি হয় দাফন নিয়ে। মেয়েটির শ্বশুর জহুরুল ইসলাম ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক দাফনে ও বাবা অক্ষয় কুমার রায় হিন্দু শাস্ত্রে সৎকারের জন্য তাৎক্ষণিকভাব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন। সেখানে কোন সমাধান না হওয়ায় আদালত মেয়েটির মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে সংরক্ষণের আদেশ দেন। সেই থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে ময়েটির লাশ সংরক্ষণ ছিল। এরপর এই মামলাটি নীলফামারী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দীর্ঘ দিন চলার পর মেয়েটির শ্বশুড় তা হাইকোটে মামলাটি নিয়ে যায়। এ নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেলে মামলাটি দ্রুত নিস্পক্তি করার জন্য হাইকোটে আবেদন করেছিল মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র। এরপর হাইকোর্টের এক আদেশে দীর্ঘ চার বছর দুই মাস পর মেয়েটির দাফন সম্পন্ন হলো।

মহিনুল ইসলাম সুজন, বিশেষ প্রতিনিধি॥