গত দুই মাসে দেশে বজ্রপাতে প্রায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বজ্রপাতে গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল এই দুদিনে ২৯ জনসহ পুরো এপ্রিলে ৫৮ জন এবং মার্চে ১২ জন নিহত হয়েছে। সোমবার এর ধারাবাহিকতায় চার জেলায় বজ্রপাতে নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও চারজন। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে দু’জন, শেরপুরে চার, হবিগঞ্জে দুই এবং সুনামগঞ্জে একজন। সোমবার (০৭ মে) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হওয়া ঝড় ও বজ্রবৃষ্টিতে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
শেরপুর: শেরপুরে পৃথক বজ্রপাতে স্কুলছাত্রীসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন- নালিতাবাড়ী উপজেলার পাঘারিয়া মির্জাবাজার গ্রামের হাফেজ সোহেল মিয়ার মেয়ে শারমিন, সদর উপজেলার হালগড়া গ্রামের আকু শেখের ছেলে আব্দুর রহিম, নকলা উপজেলার মোজারচর গ্রামের ওয়াহেদ আলীর ছেলে শহিদুল ইসলাম ও শ্রীবরদী উপজেলার বকচর গ্রামের মো. আনিসুর রহমান।

মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারে পৃথক স্থানে বজ্রপাতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো তিনজন। নিহতরা হলেন- শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের বরুণা গ্রামের ইসলাম মিয়ার ছেলে মফিজ মিয়া (৩০) ও সদর উপজেলার খলিলপুর এলাকার ফয়েজ উদ্দিনের ছেলে আবু সামাদ (১৫)। আহরা হলেন-বরুণা গ্রামের রশীদ মিয়া (৩৬), রফিক মিয়া (৫০) ও নজির মিয়া (৬০)।

হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় বজ্রপাতে দুই ধান কাটা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো একজন। নিহতরা হলেন- উপজেলার কবিরপুর গ্রামের মৃত নাদু বৈষ্ণবের ছেলে অধীর বৈষ্ণব (২৭) ও তেলঘরি গ্রামের বীরেশ্বর বৈষ্ণবের ছেলে বসু বৈষ্ণব (৩২)। আহত কৃষ্ণধন বৈষ্ণব (৩২) তেলঘরি গ্রামের হরিচরণ বৈষ্ণবের ছেলে। বানিয়াচংয়ে বজ্রপাতে ২ শ্রমিকের মৃত্যু সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় বজ্রপাতে নবকুমার দাস (৬৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। নবকুমার উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা।

ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম শুরু হলেই বিভিন্ন চ্যানেল ও সংবাদমাধ্যম বজ্রপাত নিয়ে তেতে ওঠে। জানতে চায় বজ্রপাতের সালতামামি, বাড়ছে না বেড়েই চলেছে, কারণ কী? জলবায়ু পরিবর্তন? টক শো চলে হরদম, বৈজ্ঞানিক আলোচনা, জ্ঞানচর্চা, হিসাবনিকাশ, আবহাওয়ার সতর্কবাণী, বজ্রপাতের পূর্বাভাস, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, ঝড়-বৃষ্টির সময় মাঠে যাওয়া না-যাওয়া আরও কত কী? জলবায়ুজীবীরা বজ্রপাতের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের একটা সম্পর্কের হিসাব ইতিমধ্যে বের করে ফেলেছেন। নাসার গোদার্ড ইনস্টিটিউট অব স্পেস স্টাডিজের (জিআইএসএস) কলিন প্রাইস আর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড রিন্ড তাঁদের প্রকাশিত নিবন্ধে (পসিবল ইমপ্লিকেশন অব গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ অন গ্লোবাল লাইটেনিক) জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বজ্রপাত আর দাবানল বা ফরেস্ট ফায়ারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। তাঁদের পরীক্ষাগারের তত্ত্ব অনুযায়ী (যাকে তাঁরা জিআইএসএস মডেল বলছেন), পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে, তা যদি কোনোভাবে দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে বজ্রপাতের পরিমাণ প্রায় ৩২ ভাগ বেড়ে যাবে।

কলিন প্রাইস সেই ২০০৮ সাল থেকেই বলে যাচ্ছেন, বায়ুদূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাঁর মতে, বাতাসে যত কার্বন যাবে, বজ্রপাতের ঘটনা ততই বাড়বে। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে বিগত বছরগুলোতে। বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের সহনীয় পর্যায়ে ধরে রাখার দাবি করা হলেও রাজধানীর এলাকাভেদে প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২৪৫৬ বা তারও বেশি মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। সেই হিসাবে কলিন প্রাইস আর ডেভিড রিল্ডের তত্ত্ব অনুযায়ী ঢাকায় বেশি বেশি বজ্রপাত হওয়া উচিত। হয়তো হচ্ছেও, কিন্তু রাজধানীতে বৈদ্যুতিক তারের জবরদস্ত নেটওয়ার্ক থাকার কারণে আমরা বজ্রপাতের ভয়াবহতা টের পাচ্ছি না। মানুষ মরছে না। কিন্তু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে হরদম। মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার আর নীলক্ষেতের টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ সারানোর গোটা পাঁচেক দোকানের মালিক বা মেকারের (মেকানিক) সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, এটাই তাঁদের সিজন। গত জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারির তুলনায় মার্চ-এপ্রিলে সারানোর জন্য নিয়ে আসা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের পরিমাণ প্রায় তিন-চার গুণ বেশি। তাঁদের কথা অনুযায়ী আগামী জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের কাজের চাপ অব্যাহত থাকবে। অসুরদের পরাজিত করতে দধিচি মুনির বুকের অস্থি দিয়ে বানানো মারাত্মক মারণাস্ত্র বজ্র এখন ক্রমেই ভয়ানক হয়ে উঠছে। ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার নতুন মুখ্যমন্ত্রী সবকিছুই দেব-দেবীর সৃষ্টি, নতুন কিছু নয় বলে গেরুয়াতন্ত্র গুণগান করলেও বজ্রপাত তাঁর রাজ্যের জন্যও একটা মহাবিপদ।

সারা ভারতে ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রধান পাঁচটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাবে বলছে, দাবদাহ, সাইক্লোন, বন্যা আর ভূমিকম্পের চেয়ে বজ্রপাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আলোচ্য ১০ বছরে সাইক্লোনে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলেও বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, বেড়েছে দাবদাহে মৃত্যুর হারও। তবে বজ্রপাতে মৃত্যুর হারের কাছে সেটা তেমন কিছু নয়। ২০০৪ সালে দাবদাহে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন, ২০১৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২০০ জন। অন্যদিকে ২০০৪ সালে বজ্রপাতে মারা যায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ জন আর ২০১৩ সালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ৮০০। (তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো, ইন্ডিয়া)বাংলাদেশের ২০১০ থেকে রাখা হিসাব বজ্রপাতে ক্রমান্বয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৯৯ জনের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত করা হয়। গত সাত বছরে এই হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৫১ আর গত বছর মৃত্যু হয় ২৬২ জনের। এই হিসাব কেবল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের নির্ঘণ্ট। প্রকৃত অবস্থা হয়তো আরও ভয়াবহ।

মৃতদের মধ্যে কর্মক্ষম পুরুষ বেশি: বজ্রপাতে মৃতদের মধ্যে নারী, শিশু, প্রবীণের তুলনায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেশি। দুনিয়ার তাবৎ দুর্যোগে যখন প্রবীণ, নারী, শিশুদের লাশের মিছিল সবচেয়ে লম্বা থাকে, সেখানে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় পরিবারের সবচেয়ে কর্মঠ মানুষটি। এই দুর্যোগের এটা আরেকটা ভয়াবহ দিক। পরিবারের একমাত্র রোজগারের মানুষটা চলে গেলে অন্যদের জীবনে যে কী মহাসংকটের সৃষ্টি হয়, তা বলা বাহুল্য। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে নিহত ৩৫১ জনের মধ্যে ২২০ জনই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ আর ২০১৭ সালে নিহত ২৬২ জনের মধ্যে ২০০ জনই ছিলেন পরিবারের একমাত্র ভরসা। বজ্রপাতে আনুপাতিক হারে কর্মক্ষম পুরুষ মৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্রেও বেশি। গত বছর সেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। মাত্র ১৬ জন। এই ১৬ জনের ১৫ জনই ছিলেন পুরুষ। ফাঁকা মাঠে কৃষিকাজ, মাছ ধরা বা নৌকায় করে যাতায়াতের সময় বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়ে বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় বলে মৃতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।

কী করা যায়: যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতে আগে যেখানে বছরে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন মারা যেত, সেখানে এখন মারা যায় ২০ থেকে ৪০ জন। গত বছর নিহত হয়েছে মাত্র ১৬ জন। গবেষকেরা বলছেন, নগরায়ণের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চাইতে এখন অনেক বেশি মানুষ নগরে থাকছে। বিদ্যুতের লম্বা খুঁটি মানুষের উচ্চতার অনেক ওপরে থাকায় আর খুঁটির সঙ্গে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবনহানি রোধ করে। ক্ষয়ক্ষতি হয় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির। বড় বড় গাছ ধ্বংস করে ফেলার কারণে আমাদের গ্রামাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। গ্রামের জমিদারবাড়ির ছাদে, মন্দিরের চূড়ায় কিংবা মসজিদের মিনারে যে ত্রিশূল বা চাঁদ-তারা দিয়ে আর্থিং করা থাকত, সেটাও বজ্রপাতের প্রাণহানি থেকে মানুষকে রক্ষা করত। কৃষিজমির বড় বড় চকের মাঝে আলের পাশে একটা-দুইটা তাল বা খেজুরগাছ মানুষকে বজ্রপাতের হাত থেকে এ-যাবৎ রক্ষা করেছে। সরকার নতুন করে তালগাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তবে তালগাছ বড় হতে সময় লাগে অনেক।অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা কী হতে পারে: তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল (সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সাতক্ষীরা-যশোরের বিল অঞ্চল আর উত্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর অঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। আর গত বছর প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষই মারা যান মাঠে অথবা জলাধারে (নদী, খাল, বিল) কাজ করার সময়। এসব অঞ্চলে মুঠোফোনের টাওয়ার লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়। মুঠোফোন কোম্পানিগুলো তাদের করপোরেট দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। পল্লী বিদ্যুৎ ও সীমান্তরক্ষীদের সব স্থাপনায় কমবেশি এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

ক্ষতিপূরণ-চিকিৎসা: সরকার ইতিমধ্যে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকাভুক্ত করে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে বজ্রপাতে বেঁচে যাওয়া মানুষের সঠিক চিকিৎসার কোনো স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল বা বিধিমালা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গত দুই বছরে প্রায় ৪০০ মানুষ বজ্রপাতে আহতহয়েছে। (২০১৬ সালে ১৯৬ জন এবং ২০১৭ সালে ১৮৫ জন) তাঁদের অনেকেই যথাযথ চিকিৎসার অভাবে ক্রমেই নানা ধরনের পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি বেঁচে যাওয়া মানুষের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।