ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর লালপোল ও সদর উপজেলার কাজিরবাগে বসবাস করে বেদে সম্প্রদায়ের ৪ শতাধিক মানুষ। এদের মধ্যে বসবাসকারী দুই শতাধিক শিশু কিশোরের এখন বই-খাতা আর পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তুু অভিভাবকদের বৈচিত্রময় জীবন ধারা ও অনগ্রসর বসতিতে বেড়ে ওঠা এসব শিশুরা জানেনা শিক্ষা কি? স্কুলে কি হয়? কি হবে বর্ণ শিখে আর স্কুলে গিয়ে। অজ্ঞতা আর অন্ধকারের মধ্যে বেড়ে ওঠা এসব শিশুদের কাঁধে যখন স্কুল ব্যাগ ঝুলবার কথা তখন ঝুলে সাপ।

যখন লজেন্স কিনে দেয়ার জন্য বাবা আর স্বজনদের কাছে বায়না ধরার কথা তখন তারা দু’ মুঠো খাবারের অন্বেষনে বেরিয়ে পড়ে। দূরন্তপনা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে নেয় আয় রোজগারের পথ। এ ভাবেই যুগের পর যুগ চলছে একটি সম্প্রদায়। বেড়ে উঠছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। অযতœ-অবহেলা আর শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিশুরা জানেনা জীবনের সংজ্ঞা ও তাদের অধিকারের কথা। স্কুলে না গিয়ে দিনভর দূরন্তপনা, দৌড়ঝাপ, খেলাধুলা, পরিত্যাক্ত কাগজ ও প্লাস্টিকের পন্য কুড়ানো, ডেকোরেশনের কাজ, দোকানের গ্লাস বয়, ইটভাটার শ্রমিক, সাপ ধরা, খেলা দেখানো, তাবিজ কবজ বিক্রি, সিঙ্গা দেয়া, দাঁতের পোকা বের করা, মেথর ও হরিজনসহ নানা কাজে সময় পার করে বেদে পল্লীর বসবাসকারী শিশু কিশোররা। ১৯৮১ সাল থেকেই সরকারী খাস জায়গায় স্থায়ী ভাবে ফেনীর লালপোলে বসবাস করে আসছে বেদে সম্প্রদায়ের ৫৪টি পরিবার। কাজীরবাগ বেদে পল্লীতে ভাড়া জায়গায় রয়েছে আরও ২৫টি পরিবার।

সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোল ঘেষে জুড়ে থাকা লালপোল বেদে পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কিশোর মার্বেল খেলছে। একটু মনোমালিন্য হলেই নিজেদের মধ্যে শুরু করে মারামারি আর অশালিন ভাষায় গালিগালাজ। তাদের আশপাশেই ঘুরে ফেরে ৪/৫ জন ময়লা আবর্জনা মাখা বস্ত্রহীন শিশু। তাদের মধ্যে শামিম নামের একজন কিশোর জানায়, তার মা আছিয়া বেগম, তারা দুই ভাই দুই বোন। প্রতিদিনই তার দেড় বছর বয়সী বোনটিকে রেখে সকালেই তার মা সিঙ্গা দিতে ও বাবা সাপের খেলা দেখাতে বিভিন্ন স্থানে চলে যান। তার বড় ভাই পাশের ইট ভাটায় দৈনিক ১শ টাকা বেতনে চাকুরী করে। শামিম কখনও স্কুলে যায়নি। সে জানেনা স্কুলে গেলে কি লাভ!

পাশেই দাড়িয়ে থাকা কিশোরী রৌশন আক্তার (রাশেদা) জানায়, তাদের বেদে পল্লী থেকে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে তুলাবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবেশির সহযোগিতায় তার বাবা তাকে ভর্তি করায়। কিন্তুু এখান থেকে আর কেউ স্কুলে যায়না দেখে সেও স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়েছে। এছাড়াও স্কুলের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা রাশেদার সাথে টেবিলে বসতে চায়না; কথা বলতে চায়না বলেই স্কুলে যেতে তার অনাগ্রহ। রাশেদার বাবা দুলাল মিয়া ওই কলোনীতেই চা দোকান করেন। তিনি জানান, পল্লীতে বসবাসকারী কেউই স্কুলে যায়না। স্কুল এখান থেকে অনেক দূরে। রাস্তায় নানা ধরনের গাড়ি থাকায় একা একা তার মেয়েটি স্কুলে যেতে ভয় পায় বলেই সে স্কুলে যেতে চায় না। তিনি বেদে পল্লীর দেড়শতাধিক শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে সরকার ও কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবী জানান। তবে মাস খানেক আগে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য স্থানীয় জহিরিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ওই পল্লীতে একটি মক্তব ও হুজুর নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। শহরতলীর কাজিবাগ বেদে পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শিশু-কিশোর একত্রিত হয়ে তাবিজের বাক্স তৈরী করছেন। এখানে কেউ টিন কাটছেন, কেউ বাকা করছেন, আর কেউ আটা দিয়ে তাবিজের বক্স তৈরী করছেন। এখানে কথা হয় মিজান নামের ১২ বছর বয়সী এক কিশোরের সাথে। মিজান জানায়, প্রতিদিনই সে তার বাবার সাথে জেলার বিভিন্ন স্থানে সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখানোর কাজ করে। কোন দিন কিছু আয় হয়; কোন দিন আসা যাওয়া আর নাস্তার টাকাও উঠেনা। অভাবী সংসারে তার মা এক সময় গ্রামে গঞ্জে সিরামিক (কাচের) পণ্য বিক্রি করে সংসার চালাতো। কিন্তুু এখন তার মা অসুস্থ। তাই বাবার আয় দিয়ে সংসার চলতে প্রতিদিনই টানাপোড়নের শিকার হতে হয় তাকে। স্কুলে গেলে তার বাবার জন্য সহযোগিতা হবেনা তাই সে স্কুলে যায়না।

মানুমিয়া নামের বেদে পল্লীর এক বাসিন্দা জানান, এখানে মূলত পড়া লেখার পরিবেশ না থাকায় কেউ এটি নিয়ে ভাবছেনা। সবাই ছেলে সন্তান নিয়ে আয় রোজগারে ব্যস্ত। তাই এখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রাথমিক দিকে অভিভাবকদের মাঝে কাউন্সিলিং করে তাদের সন্তানদের পড়ালেখা শেখানোর প্রতি ঝোঁক সৃস্টি করতে হবে। এতে করে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিশু কিশোরদের অভিভাবকদের সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি হলে সবাই স্কুলে আসবে। এভাবেই শিক্ষার আলোয় জেগে উঠতে পারে অজ্ঞতায় নিমর্জিত বেদে পল্লীতে বসবাসকারী একটি সম্প্রদায়। ক্রমেই ইতিবাচক ধারায় পাল্টে যাবে তাদের জীবনমান ও জীবন ধারা।

এদিকে বেদে সম্প্রদায়ের শিশু ও কিশোরদেরকে স্কুলমুখী করতে সরকারের কোন পদক্ষেপ ও প্রনোদনা আছে কিনা জানতে চাইলে সমাজসেবা বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাকুর রহিম খান পলাশ জানান, সরকার অনগ্রসর জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে আনতে নানামুখি প্রকল্প গ্রহন করেছে। ফেনীতে বেদে সম্প্রদায়সহ দলিত সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি চালু আছে। এ প্রকল্পের আওতায় ফেনীতে গত অর্থ বছরে ১৫৮ জনকে ২ লাখ ৩২ হাজার ৮শ টাকা শিক্ষাবৃত্তি দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত দলিত সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ৩শ, এসএসসি পর্যন্ত ৪শ, এইচএসসিতে ৬শ ও উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ বরাদ্ধ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। স্থানীয় তুলাবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মন্জু রানী দেবী জানান, ২০১৬ সালে রৌশন আক্তার নামের এক কিশোরী বেদে পল্লী থেকে তার স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তুু কয়েকদিন পরেই সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়।ফেনী জেলা প্রশাসক মনোজ কুমার রায় জানান, ওই পল্লীতে শিক্ষার বিস্তারে ইতোমধ্যে এনজিও ব্র্যাক একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করেছে। অনুমতি পেলেই বেদে পল্লীতে বসবাসরত শিশু কিশোরদের নিয়ে স্কুল কার্যক্রম শুরু করা হবে।