১৬কোটি জনঅধ্যূষিত চলমান রয়েছে বছর জুড়ে মাওয়া শিমুলিয়া কাঠাল বাড়ি চরজানাজাত নৌরুটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চলাচলকারী জনঅধ্যূষিত বাসিন্দাদের কাছে সবচেয়ে বেশী আলোচিত ইস্যু ছিল স্বপ্নের পদ্মা সেতু।বিগত বছরের মতো এবারও এটি আলোচিত ইস্যু হলেও এবারের চিত্র এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। দীর্ঘদিন পর এবার পদ্মাপাড়ের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষেরা পদ্মা সেতুর বাস্তব নির্মাণকাজ দেখতে পাচ্ছেন। দুমদুম শব্দতরঙ্গে মুখর এখন তাদের স্বপ্নের এ সেতু। তবে এখন তাদের কাছে একটিই প্রশ্ন কবে শেষ হবে এর বাস্তব নির্মাণকাজ ।

এদিকে মূল সেতুর কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে এক যুগেরও বেশী সময় ধরে ক্ষীণ হয়ে থাকা ১৬ কোটি জন অধ্যুষিত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নগুলো পূরণ হতে চলেছে।যেন কুয়াশাকে ভেদ করে ভোরের সোনালী ঝলমল রোদে আশার আলো জেগেছে মাওয়ার পদ্মাপাড়ে।স্বপ্নের এ সেতুর বাস্তবতার চিত্র দেখে খুশি পদ্মাপারের উভয় প্রান্তের মানুষ। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ৪জুলাই এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তুর করলেও সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের টানাপোড়েনে পিছিয়ে পড়ছিল সেতু নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়া। মাওয়ার পদ্মাপাড়ে এখন অতিপুরনো ও পরিচিত সেই দৃশ্য এখন আর কেউ খুঁজে পাওয়া যায়না।প্রকল্প এলাকার চারিদিকে এখন শুধু ভারী ভারী ধাতব পদার্থের সমারোহ।দুমদুম গর্জন দিয়ে বিরামহীন শব্দের তালে তালে বেজে চলেছে।পদ্মার দুপাড়ে বিস্তত এলাকা জুড়ে ভেসে আসা এ শব্দতরঙ্গ যেন আগে থেকে বোঝার উপায় নেই।তবে কিছু দিনের র মধ্যেই বিষ্ময় কেটে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রবেশদ্বার মাওয়া,কাওড়াকান্দি ও জাজিরা নৌপথে চলাচলকারী যাত্রী আর আগুন্তকদের মধ্যে।এটি আর কিছুই নয়,দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং কাজ। যেমন গত সপ্তাহে দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতুর ৬০০ মিটারস্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৪০ ও ৪১ নম্বর পিয়ারের ওপর চতুর্থ স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) স্থাপন করা হয়েছে। এর থেকেই দৃশ্যমান হয়েছে সেতুর ৬০০ মিটার কাঠামো। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে (সুপার স্ট্রাকচার) গুলো তৈরীকরে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও তিন হাজার ১৪০ টন ওজনের স্প্যান বহনকারী,তিন হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার ভাসমান ক্রেন ‘তিয়ান ই’,দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জাজিরা প্রান্তে ৪০ ও ৪১ নম্বর পিয়ার এলাকায় পৌঁছায়। সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, স্প্যান বহনকারী ক্রেনটিকে ৪০ ও ৪১ নম্বর পিয়ারের সামনে পজিশন অনুযায়ী আনা হয়।এরপর লিফটিং ক্রেনের সাহায্যে অস্থায়ী বেয়ারিংয়ের ওপর রাখা হয় স্প্যানটিকে, তবে স্থায়ীভাবে।তবে স্প্যানটি পিয়ারে ওঠানোর আগে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়।এদিকে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানী। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে নদীর প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে শুরু হওয়া সাত নম্বর পিলারের পাইলিংকাজের ।দুমদুম শব্দের আওয়াজে জার্মানি থেকে আনা মেনকের ২৪০ টন শক্তিসম্পন্ন হাইড্রোলিক হ্যামার (এমএইচইউ ২৪০০এস) দিয়ে নদীর বুকে পিলার পোঁতার কাজ শুরু হলে , বর্তমানে নদীর বুকে জেগে উঠতে দেখা গেছে পদ্মা সেতুর এক-একটি পিলার। সিডিউল অনুযায়ী ৩৬ মাসের মধ্যে মোট ৪২টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়েছে দ্বিতল এ সেতু।বর্তমানে সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পে পেয়েছে নতুন গতি। পদ্মার দুই পাড়ে এবং নদীর বিভিন্ন স্থানে টেস্ট পাইলিংয়ের পাশাপাশি বোল্ড পাইলিং করা হচ্ছে। এদিকে মূল পাইলিংকাজ শুরু হওয়ার পরপরই এ সেতুর কারিগরী দিক পর্যবেক্ষণে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দেশী বিদেশী ১২সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একটি টিম সেই সময় রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বৈঠক করেন। পরদিন সকাল থেকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এ টিমটি প্রকল্প এলাকার মাওয়া ও জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।এতে যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা,নেদারল্যান্ডসহ ও জাপান থেকে আগত বিদেশী ৪সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল এক্সপার্টরা এতে অংশ নিয়েছেন জানা গেছে।বুয়েটের সাবেক ভিসি প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।পদ্মার মূল পাইলিংস্থলে কথা হয় সেতুর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রীজের নিয়োজিত চিফ সার্ভিস টেকনিশিয়ান জার্মানীর হ্যামার বিশেষজ্ঞ মেনকের অলিভারের সাথে।তিনি জানান,২৪০ টন শক্তিসম্পন্ন ২৪০০এস মডেলের মেনক হাইড্রলিক হ্যামার দিয়ে কাজ পাইলিং কাজ চলছে।প্রতিটি পিলারের জন্য ১০৩ মিটার গভীরতার লক্ষ্য নিয়ে মিনিটে ৩৭বার করে মোট ২৭০বার চাপ দিয়ে এক নাগারে হ্যামারিং করা হচ্ছে। তবে এ কাজগুলো সম্পূর্ণ মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে কম্পিউটার মনিটরে হ্যামরিংয়ের কার্যকরিতা পরীক্ষা করা হচ্ছে। নদীতে প্রতিটি পিলারের জন্য ছয়টি করে পাইলিং করতে হবে।তবে পিয়ারের কাজ শেষ করে আবার ৪টি পিয়ারের কাজ করা হবে।পাইলিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা সেতুর এক একটি পিলারের ওপর বসবে সেতুর স্ল্যাব ও ট্রাস।পিলার বানানোর কাজ শেষ হলে তার ওপরে ¯¬্যাব (ছাদ) ও ট্রাস বসানো হবে।৩ মিটার ব্যাসের পাইপগুলো রড,সিমেন্ট, পাথরের ঢালাইয়ে মাধ্যমে তৈরী হবে ে সতুর পিলারের ভিত্তি। পদ্মা সেতুর রঙ হবে সোনালী। আর রাতে সেতু আলোকিত হবে লাল-সবুজ রঙে।সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়,সেতুকে ঘিরে মহাসড়ক থেকে পদ্মার এপার ওপার পর্যন্ত হাজারো শ্রমিকের কর্মচাঞ্চল্যে যোগ হয়েছে এক নতুনমাত্রা। একইসাথে ঢাকা মাওয়া মহাসড়কের দোগাছি থেকে পদ্মার দুইপাড় পর্যন্ত পাল্টে গেছে প্রকল্প এলাকার চিত্র । সড়কের দুই পাশে কয়েক মিটার পরপরই নির্মাণকাজের সাইনবোর্ড। বালু আর পাথরের বিশাল বিশাল সারি সারি স্তুপ। হলুদ হেলমেট পরিহিত নির্মাণশ্রমিকদের নিজ নিজ কাজে যেন মহাব্যস্ততা। মাওয়া সংলগ্ন কুমারভোগ এলাকার পদ্মাপাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড।এখানেই তৈরী করা হয়েছে পাইল ফ্রেব্রিকেশন ওয়ার্কশপ।এখানেই ৩মিটার ব্যাসবিশিষ্ট প্রায় ৮০ মিলিমিটার পুরু ৭০.৯০ মিটার লম্বা শত শত বিশালাকৃতির লোহার পাইপ নির্মাণ করে প্রকল্প এলাকার কুমারভোগ কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডের পদ্মা পাড়ে সুবিন্যস্ত রাখা হচ্ছে।পরবর্তীতে বিশাল ওয়ার্কশপ থেকে বের করে হুইলের মতো রেললাইন ধরে সেই পাইল বার্জে করে ক্রেনের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পদ্মার বুকে।প্রথমে ৬টি কেসিন নিয়ে একটি ব্যাজের ওপর জোগান গেড়ে প¬াটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে।এভাবেই সেতুর পিলার পয়েন্টে একের পর এক পাইলগুলো স্থাপন প্রক্রিয়া চলছে।আর নদীর বুক চিড়ে জেগে ওঠছে একের পর এক পাইলের প্ল্যাটফর্ম। কুমারভোগ পাইল ফ্রেব্রিকেশন ওয়ার্কশপে কথা হয় পদ্মা সেতুতে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কন্ট্রোলএ। তারা জানান, গত ৩বছর /১ মাস ধরে এখানে পাইল তৈরীর কাজ করছি । এখানে সেতুর টেষ্ট পাইলসহ মূল পাইলগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।সম্পূর্ণ লোহার তৈরী এসব পাইলের একেকটি সর্বোচ্চ ৮০ মিলিমিটার পুরু এবং ৭০.৯০ মিটার পর্যন্ত লম্বা রয়েছে বলে জানান । মাওয়া চৌরাস্তা এলাকার বাসিন্দা স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা আশরাফ হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যে এত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়ন করছেন তা সেতুর কাজের কাছাকাছি না আসলে কেউ বুঝতেই পারবে না।তাই এই মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন নিয়েও সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিল।আমরা আশা করছি সেতুর বাকী কাজও খুব শিগগিরই শেষ করে নির্ধারিত সময়ের আগেই আবারও প্রধানমন্ত্রী এ সেতুতে গাড়ী নিয়ে সেতুর উদ্বোধন করবেন। পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা নেতা শেখ জামান জানান,সরকার মূল সেতুর কাজ শুরু করেছেন।এতে আমরা খুবই খুশী।কেননা সেতুর কাজ শিগগিরই শেষ হলে দক্ষিণবঙ্গের অনেকগুলো জেলার সাথে আমাদের যোগাযোগ আরো দ্রুত হবে।এছাড়া পদ্মা পাড়ি দিতে দীর্ঘদিন ধরে যে দুর্ভোগ ছিল সেটাও নিরসন হবে ।