রোজার প্রথম দিন রাজধানীর চকবাজারে বাহারি ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন দোকানিরা। সেখানে ক্রেতাদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্য বছর রোজায় পুরান ঢাকার ইফতার বাজার বেলা ৩টার দিকে শুরু হলেও এবার রোজার প্রথম দিনটি শুক্রবার হওয়ায় দোকানিরা জুমার নামাজের পরপরই পসরা সাজাতে শুরু করেন। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতার ভিড়ও বাড়তে থাকে। ওই ভিড়ের মধ্যে শোনা যায় বিক্রেতাদের হাঁক ডাক- ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়’।ঢাকার অলিগলিতে ইফতারের নানা আয়োজন থাকলেও পুরান ঢাকার চকবাজারের ইফতারের পসরা সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। হাজার রকমের আয়োজন আর মানুষের কোলাহলে মুখরিত ছিল এখানকার ইফতার বাজার। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত মানুষের ঢল নামে সেখানে। তবে ক্রেতার পাশাপাশি দর্শকের সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। দূরদূরন্ত থেকে লোকজন যেমন গেছেন ইফতার কিনতে তেমনই অনেকে ক্যামেরা নিয়ে গেছেন ছবি তুলতে। প্রথম দিনে ব্যাপক লোক সমাগম হওয়ায় বিক্রেতারাও ছিলেন ভীষণ খুশি।চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার সামগ্রীর প্রধান আইটেমের মধ্যে রয়েছে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। কয়েক প্রজন্ম ধরে চলছে এর বেচাকেনা। এখানকার অন্যান্য ইফতার সামগ্রী হচ্ছে আস্ত মুরগির কাবাব, খাসির রান, কোয়েল-কবুতর ভুনা, পেঁয়াজু, বেগুনি, মোরগ পোলাও, পেল্লাই জিলাপি, পেস্তা বাদামের শরবত, মোরগ মুসাল্লাম, বটি কাবাব, টিকিয়া কাবাব, কোপ্তা, চিকেন কাঠি, শামি কাবাব, শিকের ভারী কাবাব, সুতি কাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা, আলাউদ্দিনের হালুয়া, হালিম, দইবড়া, লাবাং, কাশ্মিরি শরবতের মতো অসংখ্য মজাদার খাবার। দোকানভেদে ইফতারির দামের তারতম্যও রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে ইফতারের দামে সন্তষ্ট নন ক্রেতারা। তাদের অভিযোগ সবকিছুর দামই বেশি। অন্যদিকে বিক্রেতাদের বক্তব্য তারা তাদের সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে ইফতার ক্রেতাদের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

দুপুর বারোটার পর থেকেই চক শাহি মসজিদের সামনের রাস্তার দু’ধার দিয়ে ইফতারের দোকানগুলো বসতে শুরু করে। জোহরের নামাজের পর ক্রেতারা ভিড় করেন ইফতার কেনার জন্য। প্রথমে দু’একজন করে কিনতে আসলেও ক্রমে পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। আসরের নামাজের পর তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না গোটা এলাকায়। ওয়াটার ওয়াক্সাস রোড থেকে শুরু করে চকবাজার মডেল থানা পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় ছিল ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। এছাড়া রাস্তার অপর পাশেও ছিল ক্রেতাদের ভিড়। তবে চক শাহি মসজিদের সামনের রাস্তাটি ছিল ইফতার বাজারের প্রধান কেন্দ্র সকাল থেকে কয়েক দফা বৃষ্টিতে অধিকাংশ রাস্তা পানি-কাদায় একাকার; তার মধ্যে রোজার প্রথম দিন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার কিনতে চকবাজারে এসে ক্রেতারা খেলেন চড়া দামের ধাক্কা।

রাস্তার দুই ধারে দোকানে দোকানে সাজানো নানা রকমের কাবাব আর রোস্ট। তার সঙ্গে ছোলা, পেঁয়াজু, চপ, বেগুনি, পাকোড়া, হালিম তো আছেই। আরও আছে জিলাপি, দই বড়া, লাবাং, ফিরনি, মিষ্টি আর নানা মৌসুমি ফল।চকবাজারের ইফাতারে প্রতি বছর নতুনত্ব কিছু থাকে না। তবে পুরান ঢাকার ইফতার না হলে অনেকের আবার মুখে কিছু রোচে না রোজার প্রথম দিন।গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রীতিমত লড়াই করেই তারা ‘ঠোঙ্গা ভইরা’ বাসায় নিয়ে যান মুখরোচক সব খাবার।ভিড়ের কমতি না থাকলেও ক্রেতাদের অভিযোগ, দাম এবার অনেক বাড়তি।দোকানিরাও তা অস্বীকার করছেন না। তারা বলছেন, মাল-মশলা কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। তাই ইফতারের দামও চড়া।লালবাগের বাসিন্দা বদরুল হাসান প্রতি রোজায় চকবাজারের ইফতারের নিয়মিত ক্রেতা। এবার দাম নিয়ে তাকে দেখা গেল বেশ বিরক্ত। তিনি জানালেন, খাসির আস্ত রানের রোস্ট এবার ৬০০ টাকা চাইছে, আস্ত মুরগির রোস্ট চাইছে ৪০০ টাকা। দুই খাবারেই গতবারের তুলনায় দেড় থেকে দুশ টাকা বেশি চাওয়া হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।আনোয়ার নামে এক দোকানি জানালেন, গত বছর তিনি খাসির রানের রোস্ট বিক্রি করেছেন সাড়ে চারশ টাকায়। কিন্তু এবার খাসির দাম বেশি। আর মুরগির দাম তো গত মাস থেকেই বাড়তি। নাজিমুদ্দিন রোডের বাসিন্দা ফয়সাল হোসেনও সুতি কাবাব কিনতে এসে দাম শুনে থমকে গেলেন।

এবার দাম চাওয়া হচ্ছে সাড়ে পাঁচশ টাকা কেজি। অথচ গতবারও তিনি চারশ টাকায় কিনেছেন বলে জানালেন।এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মিজান নামের এক দোকানি বললেন, গত বছর তিনি সাড়ে চারশ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন সুতি কাবাব। এ বছর গরুর মাংসের দাম বেশি বলে কেজিতে দাম বেড়েছে একশ টাকা।এ বাজারের পুরনো বিক্রেতা শহীদ মহাজন তার দোকানে সাজিয়ে রেখেছেন রাজহাঁসের রোস্ট। দাম চাইলেন প্রতিটি দুই হাজার টাকা। আর ছোট আকারের দেশি হাঁসের রোস্ট ৫০০ টাকা।বাঙালির ইফতারে মিষ্টান্নের ভাগে জিলাপি হল অপরিহার্য অনুষঙ্গ। চকবাজারে এবার শাহী জিলাপি ২০০ টাকা, বোম্বাই জিলাপি ১৬০ টাকা আর সাধারণ জিলাপি ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।ক্রেতারা বলছেন, জিলাপির দাম এবার আগের মতই। তবে উপকরণের দাম বাড়ায় দই বড়ার দাম কেজিতে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটি অদ্ভুত নামের কারণেই বিখ্যাত। যদিও সামনা সামনি দেখার পর অনেকেরই কেনার আগ্রহে ভাটা পড়ে। আজিমপুর থেকে আসা মো. হোসেন জানালেন, চেখে দেখার জন্য এই প্রথমবার তিনি আধা কেজি কিনেছেন ২০০ টাকা দিয়ে। দই বড়া, সুতি ও জালি কাবাব, ফালুদা, গরুর কিমা, কলিজা, মগজ, মুরগির মাংসের কুচি, চিড়া, ছোলার ডাল, আলু, ডিমের মত কয়েক ডজন উপকরণ ঘি আর মশলায় মাখিয়ে বানানো হয় ‘বড় বাপের পোলায় খায়’।এবার চারশ থেকে সাড়ে চারশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গত বছর তিন থেকে সাড়ে তিনশ টাকায় এ খাবার কেনার কথা জানালেন ক্রেতারা।ইফতার বাজারের এই ভিড় কেবল চকবাজারে নয়, লালবাগের রয়েল হোটেল, আবুল হাসনাত রোডের আনন্দ বেকারি, বংশালের রাজ্জাক ও হাজী নাসিরের ইফতারি কিনতেও লাইন দিয়ে আছে মানুষ।মর্তুজা নামের একজন বললেন, কর্দমাক্ত রাস্তা আর ভিড়ের মধ্যে খানিকটা ভোগান্তি হলেও পরিবারের সবাইকে নিয়ে পুরান ঢাকার সুস্বাদু খাবারে ইফতার সারবেন, এটা ভেবেই তিনি তৃপ্তি পাচ্ছেন।