সুশিক্ষার কারিগর পেতে হলে এবং মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হলে দরকার উত্তম বিশেষায়িত শিক্ষা। এ জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক প্রয়োজন। বিশেষায়িত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভিন্ন যা সম্ভব নয়। এ জন্য নীচের প্রকল্প (হাইপোথিসিস) নিয়ে ভাবতে পারি।

১) বীজ বপন ২) চারা রোপণ ৩) গাছ লাগানো ও ৪) ফল ফলানো।

এই প্রক্রিয়ার পিছনে যিনি গুরু দায়িত্ব পালন করছেন তাঁকে বলতে পারি প্রক্রিয়ার মালিক। পুরো প্রক্রিয়াটার ৪ টি অংশ রয়েছে এবং তাঁদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য কিছু ক্ষেত্রে এক, কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন। এক এবং ভিন্ন থাকায় নিয়োগ করতে হবে যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী এবং তা নিয়ন্ত্রণ করবেন প্রক্রিয়ার মালিক। এখন এই প্রক্রিয়ার মালিককে জানতে হবে কী ধরনের কর্মী প্রয়োজন? কী তাদের কাজ? কী ভাবে সেই কাজের ইনভেন্টরি এবং মনিটরিং করতে হবে? কী শিক্ষা, কীভাবে শিক্ষা, কেন শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি।

শিক্ষাঙ্গনকে ঠিক একই ভাবে গড়ে তুলতে হলে উপরের প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করতে হবে। নিয়োগ করতে হবে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এবং তা নিয়ন্ত্রণ করবেন প্রক্রিয়ার মালিক, শিক্ষামন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পেতে হলে প্রয়োজন বিশেষায়িত শিক্ষক (প্রশিক্ষণ) বিশ্ববিদ্যালয়।  উপরের কনসেপ্ট অনুযায়ী শিক্ষাঙ্গনের বিশ্লেষণ নিম্নরুপে করা যায়:

১) প্রাইমারী ২) মাধ্যমিক ৩) কলেজ ও ৪) বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষার উপর নির্ভর করছে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণের ফলাফল। শিক্ষকের শিক্ষার উন্নয়ন প্রকল্পের আগে একটি কথা বলা বিশেষ দরকার তা হোল, অনেকেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে এর যেমন পজেটিভ দিক রয়েছে তেমনটি রয়েছে ভীষণ নেগেটিভ দিক। তার কারণ নানা ধরনের আবর্জনা এই স্যাটেলাইট টেনে আনবে নতুন প্রজন্মের মাঝে যা ধ্বংস করবে তাদের জীবনকে যদি সেটা সঠিক ভাবে মনিটরিং না করা হয়। অবস!

১) ফর্ম তৈরি বা সেট আপ করা হচ্ছে প্রাইমারী শিক্ষাঙ্গনের মূল উদ্দেশ্য। আর সেই ফর্মকে বাস্তবায়ন করার কাজ হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষকদের। প্রাইমারী বা শিশুশিক্ষার বেশির ভাগ সময় হচ্ছে অনুকরণ এবং অনুসরণের সময়। এ অবস্থায় একজন ভালো শিক্ষকের গুরুত্বপুর্ণ কাজ হচ্ছে শিশুকে পদে পদে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে মনিটরিং করা এবং তার ভাল-মন্দের যাচাই-বাছাই করা। শিশুকে সব সময় ভাল কাজে ইন্ধন যোগানো, তার ভাল ক্রিয়েটিভিটির প্রশংসা করাই এই স্তরের শিক্ষকদের মৌলিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এখানে একজন শিক্ষকের যথেষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল, অর্থনীতিতে। থাকতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর চিন্তাধারা। অনেকটা বলতে হবে ৩৬৫ ডিগ্রি ম্যানেজমেন্ট লিডারশিপ।

 আছে কি সর্বত্র প্রত্যেকটি প্রাইমারী শিক্ষকের তেমন যোগ্যতা? কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব?

২) মাধ্যমিক প্রশিক্ষণ আরো জটিল অধ্যায়।এখানে শিশু শিশুকাল পার করে কৈশোরে প্রবেশ করে শারীরিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে যৌবনের আবির্ভাব হয় তার। প্রশ্ন নিজের আইডেনটিটির উপর, এ সময় হরমোনের এক বিশাল পরিবর্তন হয়। সর্বোপরি, সঠিক পথ নির্ধারণের সময় একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষক নন, তিনি অভিভাবক, পরিচালক, বন্ধু। মনোবিজ্ঞানের উপর প্রচুর দক্ষতা, শিক্ষা দানের উপর দক্ষতা থাকতে হবে। এখানে শিক্ষার্থীর হাজারও প্রশ্ন, সাথে থাকে বেশ উছশৃংখল মনোভাব।
আজকের এই ডিজিটাল যুগে সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির সাথে সাথে হাজারো অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, ছাত্র/ছাত্রীরা প্রতিদিন প্রচুর সময় ব্যয় করছে ভার্চুয়াল কর্মকান্ডে, তাদের যেমনটি পড়াশুনোর প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। সাথে তারা যেহেতু টিভি, টেলিফোন, কম্পিউটার বা প্লেস্টেশন নিয়ে বেশ ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে তাই হচ্ছে না তেমন অবসর বা বিশ্রাম পড়ছে প্রচুর চাপ তাদের ব্রেনে, হচ্ছে না সময়মত ঘুম। ফলে ক্লাসের শিক্ষাকে সঠিকভাবে ফলো করতে সক্ষম না হওয়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে পড়াশুনোর উপর। এসব দিক বিবেচনা করতে হবে এবং সুশিক্ষার উৎপাদন বাড়াতে হলে শিক্ষা পদ্ধতির ধরন পাল্টাতে হবে । দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতার সাথে সাথে সঠিক পথে শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করতে হবে এবং লার্নিং বাই ডুইং পদ্ধতি ব্যবহার শেখানো হবে শিক্ষকদের গুরুদায়িত্ব।

 তাঁরা পেয়েছে কি সে ধরনের শিক্ষা? বা দেওয়া হচ্ছে কি সে প্রশিক্ষণ কোথাও? কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব?

৩) কলেজ জীবনটা এক চলমান জাহাজ, যেন চলছে সাগর পাড়ির উদ্দেশ্যে। এসময় একজন শিক্ষার্থীর জানতে হবে তার গন্তব্য স্থান এবং কোন গতিতে এবং কীভাবে চলতে হবে এমন ধরনের পরিচালনার কাজ হবে এই পর্যায়ের শিক্ষকের। এখানে এক নতুন জীবনের শুরু। এখানে প্রেমপ্রীতি, রাজনীতি পাল্টে দিতে পারে পুরো জীবনের মোড়। ভালো গাইডেন্সের অভাব দেখা দিলে জীবন বৃথা হয়ে যেতে পারে, এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীকে তার নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে সৃজনশীল হতে হবে এবং একই সাথে শিক্ষককে দৈনন্দিন সম্পর্ক তৈরি করার সাথে রেগুলার ফিডব্যাক দিতে হবে। শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর একটি মনোরম বোঝাপড়া তৈরি করাও খুব গুরুত্বপুর্ণ বিষয়।

 হয়েছে কি ভাবা এমন করে? পেয়েছেন কি তেমনটি ট্রেনিং ? কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব?

৪) বিশ্ববিদ্যালয় একটি মিলনায়তন যেখানে লাস্ট পাকেজিং হবে জীবন গড়ার শেষ স্টেজ। এখানে পলিশিং করতে হবে শিক্ষার, একই সাথে ইন্ট্রোডিউজ করতে হবে নতুন জীবনের শুরুকে। ছাত্র/ছাত্রীকে শেখাতে হবে কী ভাবে তারা তাদের বেস্ট পারফরমেন্সের মাধ্যমে নিজেদেরকে বিক্রি করতে সক্ষম হবে। শিক্ষার শেষে দেশগড়ার কাজে একজন আদর্শ নাগরিকের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকা প্রয়োজন তা যখন তারা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমান করতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, তখনই একজন আদর্শ শিক্ষকের মূল উদ্দেশ্য হবে সফল এবং সার্থক, অর্জিত হবে তাঁর লক্ষ্য ।

 হচ্ছে কি তেমনটি? পাচ্ছি কি প্রত্যাশিত উৎপাদন শিক্ষকদের থেকে? না পাবার কারন কী ? কী ভাবে তা অর্জন করা সম্ভব?

সুশিক্ষার কারিগর পেতে হলে এবং মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হলে দরকার এই বিশেষাযিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টের মধ্যে জানতে হবে- জানতে হলে শিখতে হব, শিখতে হলে পড়তে হবে, আর পড়তে হলে মাইন্ডসেটের পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষকদের, তবেই হবে শিক্ষার স্বার্থকতা আর শিক্ষক হবে সুশিক্ষার কারিগর।

রহমান মৃধা, পরিচালক ও পরামর্শেক সুইডেন থেকে।
Rahman.Mridha@ownit.nu