এক অনন্য সাধারণ বাংলাদেশি! বাংলার ইতিহাসে আর কখনো এমন মানুষের জন্ম হবে কি না সন্দেহ! তাঁর নাম ছয়ফুর রহমান। পেশায় ছিলেন বাবুর্চি। খুব নামিদামি বাবুর্চি এমন নয়। সিলেটের সালুটিকর নামের একেবারেই গ্রাম্য বাজারের পাশের ছাপড়া ঘরের দিন আনি দিন খাই বাবুর্চি। তাঁর দ্বিতীয় পেশা ছিল ঠেলাগাড়ি চালনা। যখন বাবুর্চিগিরি করে আয় রোজগার হতো না তখন ঠেলাগাড়ি চালাতেন। কিন্তু এই লোকটির ছিল অসম সাহস। যেকোনো ইস্যুতে তিনি একেবারেই জনসম্পৃক্ত রাজনীতি করতেন। ধরুন সালুটিকর থেকে শহরে আসার বাসভাড়া আটআনা বেড়ে গেছে। ছয়ফুর রহমান কোর্ট পয়েন্টে একটা মাইক বেঁধে নিয়ে ওইদিন বিকালে প্রতিবাদ সভা করবেনই করবেন।

বক্তা হিসেবে অসম্ভব রসিক লোক ছিলেন। ছড়ার সুরে সুরে বক্তৃতা করবেন। তারপর মূল ইস্যু নিয়ে অনেক রসিকতা করবেন; কিন্তু দাবি তাঁর ঠিকই থাকবে। তার বক্তৃতা শুনতে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের ভিড় হতো। তো বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেই তিনি একটুকরো কাপড় বের করে সামনে রাখতেন। তারপর সবাইকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন, ‘আমি এই যে আপনাদের জন্য আন্দোলন করতেছি, আমার মাইকের খরচ দিবে কে? মাইকের খরচ দেন।’

অদ্ভুত ব্যাপার হল, কোনোদিনই মাইকের খরচ উঠতে দেরি হয়েছে এমনটা হয়নি। দুই টাকা, এক টাকা করে তার সামনের কাপড়টি ভরে উঠত। তারপর যখন তিনশ’ টাকা হয়ে গেল তখন মাইকের খরচ উঠে গেছে; তিনি তার কাপড়টি বন্ধ করে দিতেন। অনেক সময় তার লেখা বই বিক্রি করেও জনসভার খরচ তুলতেন। অদ্ভুত কয়েকটি চটি সাইজের বই ছিল তার। একটির নাম ‘বাবুর্চি প্রেসিডেন্ট হতে চায়’। সেই বইটির পেছনে তার দাত-মুখ খিচানো একটা সাদাকালো ছবি, নিচে লেখা ‘দুর্নীতিবাজদেরকে দেখলেই এরকম ভ্যাংচি দিতে হবে’।

ছয়ফুর রহমান প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আশির দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে। তখন দেশে সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। তো সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নিরাপত্তার জন্যই সঙ্গে পুলিশ দেওয়া হলো। ছয়ফুর তাঁর নিরাপত্তার জন্য দেিয়া পুলিশ প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘এদেরকে খাওয়ানোর সাধ্য আমার নাই’। তবু সরকারি চাপাচাপিতে তাকে নূন্যতম দুইজন পুলিশ সঙ্গে নিতে হলো।

সে সময় দেখা যেত রিক্সায় দুইপাশে দুই কনেস্টবল আর ছয়ফুর রহমান রিক্সার মাঝখানে উঁচু হয়ে বসে কোথাও যাচ্ছেন। নির্বাচনে খারাপ করেননি। সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৬০-৬৫ জন প্রার্থীর মাঝে ৮ নম্বর হয়েছিলেন। তারপর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি দেশের ৮ নম্বর প্রেসিডেন্ট। ইলেকশনের দিন বাকি ৭ জন মরে গেলে আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারতাম।’

অদ্ভুত এবং মজাদার সব নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল তাঁর। যেমন, দেশের কোনো রাস্তাঘাট পাকা করার দরকার নেই! রাস্তা তুলে দিয়ে সেখানে খাল করে ফেলতে হবে! নদীমাতৃক দেশে সেই খাল দিয়ে নৌকায় লোকজন চলাচল করবে! খালের পানিতে সেচ হবে-সব সমস্যার সহজ সমাধান। তাঁর দলের নাম ছিল ‘ইসলামি সমাজতান্ত্রিক দল’। সেই দলে কোনো সদস্য নেওয়া হতো না। এমনকি উনার স্ত্রীকেও সদস্য করেননি। তিনি বলতেন, ‘একের বেশি লোক হলেই দল দুইভাগ হয়ে যাবে’।

ছক্কা ছয়ফুর বেশ কয়েকবার নির্বাচন করেছেন। কখনোই তাঁকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি; সবাই মজার ক্যান্ডিডেট হিসেবেই নিয়েছিল। কিন্তু তিনি ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে সিলেট সদর উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে এক কাণ্ড ছিল বটে। যথারীতি ছয়ফুর রহমান প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রতীক-ডাব। তিনি একটা হ্যান্ডমাইক বগলে নিয়ে একা একা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার লিফলেট কিছুই নেই। কিন্তু বক্তৃতা তীর্যক। বাকি প্রার্থীদেরকে তুলাধুনা করে ফেলছেন। এরকম এক সন্ধ্যায় সিলেটের টিলাগড়ে তার উপর অন্য এক প্রার্থীর কয়েকজন পান্ডা হামলা করে বসল।

পরের দিন সেই খবর গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ বিরক্ত হলো। আহা! একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ, তাঁর সঙ্গে গুন্ডামি করার কী দরকার ছিল?

ওইদিন বিকালে স্কুল ছুটির পর প্রথম মিছিল বের হলো সিলেট পাইলট স্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে। মিছিল লালদিঘীর রাস্তা হয়ে বন্দরবাজারে রাজাস্কুলের সামনে আসার পর রাজাস্কুলের ছেলেরাও যোগ দিল। ব্যস, বাকিটুকু ইতিহাস। মুহূর্তেই যেন সারা শহরে খবর হয়ে গেল। সন্ধ্যার মধ্যেই পাড়া-মহল্লা থেকে মিছিল শুরু হলো ছয়ফুরের ডাব মার্কার সমর্থনে। একেবারেই সাধারণ নির্দলীয় মানুষের মিছিল। পাড়া মহল্লার দোকানগুলোর সামনে আস্ত আস্ত ডাব ঝুলতে থাকল। রিক্সাওয়ালারা ট্রাফিক জ্যামে আটকেই জোরে জোরে ‘ডাব, ডাব’ বলে চিৎকার শুরু করে! সেই স্লোগান ম্যাক্সিকান ওয়েভসের মতো প্রতিধ্বনি হয়ে এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় চলে যায়। অনেক প্রেসমালিক নিজেদের সাধ্যমতো হাজার দুইহাজার পোস্টার ছাপিয়ে নিজেদের এলাকায় সাঁটাতে থাকলেন। পাড়া-মহল্লার ক্লাব-সমিতিগুলো নিজেদের উদ্যোগে অফিস বসিয়ে ক্যাম্পেইন করতে থাকল।

অবস্থা এমন হলো যে, ছয়ফুর রহমানকে নির্বাচনী সভায় আনার এপয়েন্টমেন্ট পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেল। ছয়ফুর রহমান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তাঁদের অফিস ছেড়ে দিল ছয়ফুরের নির্বাচনী প্রচার অফিস হিসেবে। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা তাঁর নির্বাচনী জনসভার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেখানে আনতে হলেও আগে মূল অফিসে গিয়ে ৫০০ টাকা এডভান্স করে আসতে হয়, নইলে ছয়ফুর রহমান আসেন না! কারণ, তাঁর বাবুর্চিগিরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফুলটাইম নির্বাচন করতে হলে সংসার খরচ দরকার। আমার মনে হয় তিনিই একমাত্র প্রার্থী, যাকে তাঁরই নির্বাচনী জনসভায় নিয়ে আসার জন্য উল্টো টাকা দিতে হচ্ছে।

নির্বাচনের দিন জনগণ এক মহ-বিস্ময় প্রত্যক্ষ করল। আওয়ামীলীগের প্রার্থী ইফতেখার হোসেন শামীম জামানত রক্ষা করেছিলেন। আর মেজর জিয়ার দল সহ বাকি সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। ডাব প্রতীকে ছয়ফুর পেয়েছিলেন ৫২ হাজার ভোট আর চাক্কা প্রতীকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ইফতেখার হোসেন শামীম পেয়েছিলেন ৩০ হাজার ভোট। দক্ষিণ সুরমার এক কেন্দ্রে ছয়ফুর রহমানের ডাব পেয়েছিল ১৮০০+ ভোট! ওই কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রজাপতি মার্কা পেয়েছে কুল্লে ১ ভোট।

আরও অবাক করা একটি ব্যাপার ঘটে নির্বাচনের দিন। প্রায় ভোটকেন্দ্রে জনগণ ডাব মার্কার ব্যালেটের সাথে টাকাও ব্যালেটবাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। নির্বাচনের পরে ছয়ফুর রহমানের নাম পড়ে গেল ছক্কা ছয়ফুর। তিনি হাসিমুখে সেই উপাধি মেনে নিয়ে বললেন, ‘নির্বাচনে ছক্কা পিটানোয় মানুষ এই নাম দিয়েছে’। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ছক্কা ছয়ফুর সফল ছিলেন। তাঁর মূল ফোকাস ছিল প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা ঠিক করা। হুটহাট যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে পড়তেন। শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই শোকজ করে দিতেন। সেই সময় প্রাইমারি স্কুলগুলো উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল অনেকটাই।

তবে ছয়ফুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ নিতে হয় বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কারণে। ইউনিয়ন পরিষদের দুর্নীতি বন্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। এতে ক্ষিপ্ত চেয়ারম্যানরা একজোট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দিলে যতদূর মনে পড়ে তাঁর উপজেলা চেয়ারম্যানশিপ স্থগিত করে মন্ত্রণালয়। পরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পরিষদ বাতিল করে দিলে ছক্কা ছয়ফুরের স্বল্পমেয়াদী জনপ্রতিনিধিত্বের চিরতরে ইতি ঘটে।

এক নির্বাচনে খরচের জন্য তিনি কিছু টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কোনো কারণে হয়নি। কিন্তু ছয়ফুর জনগণের টাকা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে সেই ঐতিহাসিক কোর্টপয়েন্টে আবার আসলেন। এসে বলেলেন, ‘আপনারা তো আমাকে নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন হচ্ছে না; তাই আমি আপনাদের টাকাগুলো ফেরত দিতে চাই।’ লোকজন অনেক খুশি হয়ে বলল, ‘আমরা টাকা ফেরত নিতে চাই না; এগুলো আপনি নিয়ে নিন’।

তিনি যখন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হলেন তখন রেজিষ্টারি মাঠে তার প্রথম জনসভা ছিল। হাজার হাজার মানুষের ঢল। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তিনি তার বক্তব্যে প্রথমেই সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার নির্বাচনের শুরুতে আমার দুইটা ঠেলাগাড়ি ছিল। সংসার চলে না তাই একটি বেছি লাইছি। আর আমার বাড়িতে আপনারার বসাবার জায়গা ও নাই। পয়লা যখন রিলিফের চালান পাইমু সেখান থেকে কিছু বেছিয়া আপনারার বসাবার জায়গা করবো যদি আপনারা অনুমতি দেন।’ তখন হাজার হাজার জনগণ একসাথে হেসে উঠে বলল, ‘অনুমতি দিলাম’। তিনি ছোট ছোট কয়েকটি বইও রচনা করেন। ‘বার্বুচি প্রেসিডেন্ট হতে চায়’, ‘পড়, বুঝাে, বল’ তার আলোচিত বই।

জীবনের শেষ সময়ে এই মহান মানুষটি সিলেট ডিসি অফিসের বারান্দায় চিকিৎসা খরচের দাবীতে অনশন করেছিলেন এবং দাবী আদায়ও করেছিলেন। চিরকালীন দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেই এই মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সরলপ্রাণ এই সমাজবিপ্লবীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

#আবুল কালাম আজাদ

====YOU MAY LIKE THE FOLLOWING ARTICLES TOO====

উপজেলা নির্বাচন: সিলেট: আবারও ‘ছক্কা ছয়ফুর’

দর্শনির বিনিময়ে নানা বিষয়ে বক্তৃতা শোনার প্রথা থাকলেও টাকা দিয়ে রাজনীতিবিদদের কথা শোনার প্রথা এ দেশে নেই। এটি চালু করেন সিলেটের ছয়ফুর রহমান। তার বক্তৃতা শুনতে গাঁটের পয়সা খরচ করতে হতো। তবে এ ক্ষেত্রে টিকিট কেনার ঝামেলা পোহাতে হতো না। তাকে কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে নেয়ার একমাত্র শর্ত ছিল তার সংসারের একদিনের খরচ বহন করতে হতো আয়োজকদের। তারপরও পিছু হটতেন না ছয়ফুর শুভানুধ্যায়ীরা। উপরন্তু সে সময় ছয়ফুরের শিডিউলই পাওয়া যেত না। কোনো পাড়ায় বক্তৃতা করার জন্য নিতে অনুষ্ঠানের তিন চারদিন আগেই ‘সাইনিং মানি’সহ অগ্রিম বায়না করে আসতে হতো। আর এই অর্থ সংগ্রহে পাড়ার তরুণরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলতেন। পাড়ার গৃহিণীরা শরিক হতেন এই ছয়ফুর সমাবেশের অর্থ সংগ্রহে। যেসব গৃহিণী টাকা দিতে পারতেন না তারা সামর্থ্য মতো চাল-ডাল কিংবা গাছের লাউ-কুমড়া দিয়ে শরিক হতেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এমনই জনপ্রিয়তা ছিল তার।

নিজের নাম লিখতে গিয়ে তিনি সবসময়ই লিখেন ‘আল্লাহর গোলাম ছয়ফুর রহমান’। নির্বাচনী প্রচারপত্র কিংবা
হলফনামায় এমনটিই লেখা। আর সিলেটবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ‘ছক্কা ছয়ফুর’ হিসেবে। ’৯০-এর উপজেলা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে বিজয়ী হওয়ায়ই তার নামের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে যায় ছক্কা বিশেষণটি। ছয়ফুর রহমানও স্বীকার করলেন এমন কথা। তিনি বলেন ‘নব্বইয়ের উপজেলা নির্বাচনে তো আমি ওভার বাউন্ডারি মারছিলাম। সিলেটের সব জনপ্রিয় প্রার্থীরে হারাইয়া আমি হিট। ইতা দেখিয়া কোন পাবলিকে আমার নামের লগে ছক্কা লাগাই দিছইন। তয় এতে আমি খুশি।’
এখন ছক্কা বিশেষণে তিনি খুশি জানালেও বছর দশেক আগে উল্টোরকম হুমকিই দিয়েছিলেন তিনি। নামের পূর্বে কেউ ছক্কা লিখলে মামলা করার হুমকি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেসময়। সে প্রসঙ্গে ছয়ফুর বলেন, ‘আসলে আমার ভক্তবৃন্দ আর অত্মীয়স্বজনের চাপে পড়িয়া ইতা করছি। তারা মনো করইন নামোর লগে ছক্কা লাগাইয়া আমারে নেগলেট করা অর।’ এবারও সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সিলেট তথা দেশের এই আলোচিত ব্যক্তি।

রাষ্ট্রপতি থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সকল নির্বাচনেই প্রার্থী হয়েছেন ছয়ফুর। সংসদ প্রার্থী ছিলেন তিনবার। একবার উপজেলা ছাড়া বাদবাকি সময় পরাজিতই হয়েছেন তিনি। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সারাদেশে আলোচিত হন ছয়ফুর। এ নির্বাচনে আটজন প্রার্থীর মধ্যে অষ্টম স্থান অর্জন করেন। সেসময় এ ব্যাপারে নিজের প্রতিক্রিয়ায় ছয়ফুর বলেছিলেনÑ ‘আমি দেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি। আমার পূর্বের সাতজন মারা গেলে আমিই হব দেশের রাষ্ট্রপতি।’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে হোটেল ব্যবসা ছিল তার। এ সময় একটি বই লিখেন ছয়ফুর রহমান। যার নাম ‘বাবুর্চি যখন রাষ্ট্রপতি হতে চায়’। মুক্তিযুদ্ধের সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ছয়ফুর। ছিলেন সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার।

১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় উপজেলা নির্বাচনে সিলেট সদর উপজেলায় বিভিন্ন দলের প্রভাবশালী নেতাদের হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ছয়ফুর রহমান। এ সময় অনেকটা কাকতালীয়ভাবে নির্বাচিত হয়ে সবাইকে আশ্চর্য করে দেন তিনি। সেসময় ছয়ফুরের ডাব প্রতীকের সমর্থনে উচ্চারিত জনপ্রিয় স্লোগান ‘নিজের খাইয়া ডাব’ আজও সিলেটবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত। এই নির্বাচনে সিলেটে পঞ্চায়েতভিত্তিক ভোট প্রদানের দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে ভোটাররা ক্ষমতা তুলে নেয় নিজের হাতে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের শীর্ষ ব্যক্তিদের পছন্দের প্রার্থীর বিপক্ষে দাঁড়ায় সাধারণ ভোটাররা। বিশেষ করে সেই সময়ের নতুন ভোটার ও তরুণ সমাজ ছক্কা ছয়ফুরের পক্ষে ভোট বিপ্লব ঘটায়। ওই নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা ছিলেন বিভিন্ন দলের প্রভাবশালী প্রার্থীদের কাছে উপেক্ষিত।

অভিযোগ ওঠে, পঞ্চায়েতের শীর্ষ গুটিকয়েক ব্যক্তি প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গ্রাম ও এলাকাভিত্তিক ভোট বিক্রি করে দেয়ার। এমন অভিযোগে ফুঁসে ওঠে স্থানীয় নতুন ভোটার ও যুবসমাজ। তারা অবস্থান নেন এর বিপক্ষে। জোটবদ্ধ হয়ে তারা মাঠে নামেন ছক্কা ছয়ফুরের ডাব প্রতীক নিয়ে। এ সময় ছয়ফুর রহমানকে সম্মানীর বিনিময়ে জনসভায় বক্তৃতা করাতে শুরু হয় যুবসমাজের মধ্যে প্রতিযোগিতা। অনেকের মতে, দেশে নির্বাচনের ইতিহাসে ছক্কা ছয়ফুরই একমাত্র প্রার্থী, যার প্রচারণার সব দায়ভার সাধারণ ভোটাররা তুলে নেন নিজেদের কাঁধে। সিলেট শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে জোয়ার ওঠে ছক্কা ছয়ফুরের ডাবের পক্ষে। সেই জোয়ারে ধরাশায়ী হন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা। ৫৪ হাজার ভোট পেয়ে প্রায় ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে সিলেট সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ছয়ফুর রহমান। নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীম। এছাড়া প্রার্থী হয়েছিলেন জেলা বাকশাল নেতা আশফাক আহমদ, জাতীয় পার্টির শাহ আলম, জাসদের আকম ইকবাল মাশুক, তৎকালীন চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুল সমর্থিত শাহদাৎ রহিম।

নির্বাচিত হয়ে ২১ মাস দায়িত্ব পালনকালে অনেক ঘটনার জš§ দেন ছয়ফুর। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে উপজেলা পরিষদ বিলুপ্ত করলে তিনি পদছাড়া হন। পরবর্তীতে ইসলামী দল বাংলাদেশ নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেন। বড় কোনো দলে যোগ না দিয়ে নিজেই নতুন দল গঠন সম্পর্কে ছয়ফুর বলেন ‘সব দলই দুর্নীতির আখড়া। আমার দল অনেক বালা। চরিত্র নষ্ট করিয়া লাভ নাই।’ তিনি বলেন ‘আমি অন্য দলে যোগ দিতাম কেনে? সুযোগ পাইলে আমি হাসিনাÑখালেদারে আমার দলে যোগ দেয়ার লাগি কইমু।’ চারদলীয় জোট শাসনামল সম্পর্কে তার মন্তব্য ‘ইটা আছিল শয়তানের জোট।’ আর এবার আ’লীগে বিজয় সম্পর্কে ছয়ফুর রহমান বলেন ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি থাকি শতগুণে বালা।’

উপজেলা চেয়ারম্যন থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান ছয়ফুর। অসুখ আর অভাব হয়ে ওঠে তার নিত্যসঙ্গী। অভাবের তাড়নায় রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছয়ফুর রহমান সালুটিকর ফেরিঘাটে টোল আদায়ের কাজও করেন অনেকদিন। নিজের দিনকাল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ছয়ফুর বলেন ‘খাইয়া না খাইয়া কুনোরকমে চলে। এই জাতি একটা অকৃতজ্ঞ জাতি। আমার মতো বিখ্যাত মানুষ অসুখে ভোগে আর এই জাতি কুনো খবর লয় না। ইটা জাতির দুর্ভাগ্য।’

এই ক্ষ্যপাটে লোকটির এবারের নির্বাচনী প্রতীক কাপ-পিরিচ। এই শীতে গরম চা পান করে ভোটাররা কাপ-পিরিচে ভোট দেবে বলে মন্তব্য করেন ছক্কা ছয়ফুর। তবে নির্বাচনের আগে সরকারের কাছে নিজের চিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন ছয়ফুর রহমন। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে এ আবেদন জানান তিনি। আবেদনপত্রে তিনি লিখেন ‘আমার খাদ্যনালিতে রোগ ধরা পড়েছে। যার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা। এই প্রচুর অর্থ আমি একজন গরিব মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেনেইজ করা সম্ভব নয়।’ এতে সরকারি খরচে চিকিৎসা প্রদানের আবেদনের সঙ্গে রয়েছে আন্দোলনের হুমকিও। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অনশন ধর্মঘট পালনের হুমকি দেন তিনি। আবেদনপত্রের সবশেষে ছয়ফুর রহমান উল্লেখ করেন ‘একদিকে অনশন অপরদিকে নির্বাচনী প্রচার কার্যক্ষম পরিচালনা করিয়া যাইতে থাকব।’

দেবাশীষ দেবু

==============================

রাজনীতিবিদদের আস্ফালন এবং ইতিহাস বিকৃতির ধারা

অন্তত দুই যুগ আগে সিলেটে একজন জনপ্রতিনিধির আবির্ভাব হয়েছিল, তাকে অনেকেই চেনেন। খুবই পরিচিত। জনপ্রিয়তাও যে তার ছিল না তা বলা যাবে না। কারণ তিনি একবার সিলেট সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। এর আগে অবশ্য তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিলেন। তিনি শুরু থেকেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খুব পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তার বক্তৃতার কথা সবাই জানতো। সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে বলুন আর রাজধানীর কোনো সভাস্থলে বলুন তার জনসভায় জনসমাগম হতো। বক্তৃতার আগে তিনি মাইকের ভাড়া পরিশোধের জন্য টাকা তোলতেন, বলতেন তাকে সহযোগিতা না করলে তিনি বক্তৃতা দিতে পারবেন না। হাস্যরস, প্রগলভতা, পাগলামো যত প্রকার বিশেষণ আছে তা সেই জনপ্রতিনিধির বেলায় ছিল প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালীন মাঝে মাঝে তিনি হঠাৎ করে জনসমক্ষ থেকে হারিয়ে যেতেন, এমনকি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেকে ছক্কা বানিয়ে ফেলতেন। আর এভাবেই সারা দেশব্যাপী ছক্কা ছয়ফুর হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। তার জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে অর্থাৎ সেই নির্বাচনকালীন এক বামপন্থী দলের কর্মিসভায় সিলেটের এক নেতা স্থানীয় রাজনীতির হালচাল তুলে ধরে বলছিলেন, সিলেট এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষ এতোই বীতশ্রদ্ধ যে, জনগণ একজন পাগলকে ভোট দিয়ে দেবে। পাগল কি সুস্থ, সে কথা পরের ব্যাপার জনগণ কিন্তু ভোট দিয়েছিল ছক্কা ছয়ফুরকেই, সচেতনভাবে। তার ডাব প্রতীক যেন হয়ে গিয়েছিল সে সময়ের সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচনের একমাত্র প্রতীক। আমরা যেভাবেই বিশেষায়িত করি না কেন ছক্কা ছয়ফুর কিন্তু জনপ্রতিনিধি হয়েও দুর্নীতি তাকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। তিনি তার কথাবার্তায় হয়ত হাস্যরস সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন ঠিকই, হয়ত আধপাগলা মানুষ হিসেবেও নিজেকে পরিচিত করেছিলেন কিন্তু চোর-দুর্নীতিবাজ কিংবা টেন্ডারবাজের কালিমা তাকে স্পর্শ করেনি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এরকম ছক্কা ছয়ফুরের প্রাদুর্ভাব এখন পর্যন্ত ঘটেনি। তবে রাজনীতিতে দেউলিয়াত্ব যেন ক্রমশই বাড়ছে, সারা দেশব্যাপী। রাজনৈতিক দায়বোধ তো অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের নেই-ই, বিবর্জিত হচ্ছে এমনকি নৈতিক দায়বোধ। হত্যা-গুম-টেন্ডারবাজি প্রভৃতি তো আছেই। রাজনীতির মাঠ গরম রাখতে আমাদের নেতা-নেত্রীরা মাঝে মাঝে বেফাঁস কথা বলেন। কিন্তু ছক্কা ছয়ফুরের সঙ্গে পার্থক্য হলো এরা হাস্যরস সৃষ্টি করতে পারেন না। ছয়ফুর আর কিছু না হোক মানুষকে হাসাতে পারতেন, নির্বিকারভাবে কথা বলতেন। আর আমাদের এখনকার নেতারা সিরিয়াস থাকেন। তারা এখন রাজনীতিবিদদের ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য বলেন, দুর্নীতিবাজ হওয়ার উপদেশ দেন প্রকাশ্যে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ছাত্রছাত্রীদের চাকরি পাইয়ে দেয়ার জন্য যখন বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষায় পাস করো, ভাইভায় তো আমরা আছিই’, তখন আর রাজনীতিকে মনে হয় মূলত ডাকাতি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার এক জায়গাই। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-ক্যাডার পালন এই পর্যায়ে চলে গেছে যে, এই নেতারাই একে একে সারা দেশটাকে মেধাহীন বানিয়ে দিচ্ছেন, মেধাশূন্য শ্মশান বানাতে তারা যেন কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছেন। জানি উপদেষ্টা হয়ত মনে করছেন টেন্ডারবাজি, অভ্যন্তরীণ খুনোখুনি প্রভৃতি থেকে ফিরিয়ে আনতে তিনি সরাসরি এদের চাকরির অফারই দিয়ে দিচ্ছেন। তাহলে অর্থটা কি দাঁড়াচ্ছে, ছাত্রত্ব শেষে চাকরি করতে হলে ছাত্রলীগ করো। এখানে টেন্ডার ছাড়াই চাকরি জুটে। আমরা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়র ভিসি সিদ্ধান্ত নেন ছাত্রলীগের ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী। কে শহীদ মিনারে যাবে, কাকে যেতে দেয়া হবে না, সে দায়িত্ব নিয়ে নেন তিনি। উপদেষ্টা যে ছাত্রদের পরীক্ষায় পাস করার কথা বললেন, তারা কি পরীক্ষায় বসার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন। তারাতো পরীক্ষা ছাড়াই কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানাচ্ছে। তাদের পরীক্ষায় বসার প্রয়োজন নেই। অবশ্য উপদেষ্টা এ কথাটি বলে ওদের রোজগারের নতুন পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। এরা এখন দেদার ছাত্রলীগ বানাবে। মেধাবী ছাত্রদেরও এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা তাদের মাধ্যমেই আসবে। লাখো-কোটি টাকার বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত এখন বৈধভাবে তাদের হাতের মুঠোয়। দলের কিংবা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে কিংবা পারস্পরিক ঈর্ষায় অন্যকে ঘায়েল করতে দলীয় ক‚পমণ্ড‚কতার এই রাজনৈতিক শ্মশানে সে জন্যই সৃষ্টি হচ্ছেন আমাদের আজগুবি সব নেতারা। যে যেভাবে পারছে, সেভাবেই কথা বলে সামনে আসছে। লতিফ সিদ্দিকী আসলেন, এবার আসলেন ইমাম আর অন্যদিকে আছেন তো আমাদের এই বিলেতে জনাব তারেক রহমান।

দুই. লন্ডনে অবস্থান করছেন বাংলাদেশের সরকারবিরোধী রাজনীতির প্রধান দিকপালের তনয়। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে। লালিত-পালিত হচ্ছেন বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে। তার কর্মীদের কেউ কেউ আমার বন্ধুস্থানীয়ও। এদের দেশীয় উচ্চতর শিক্ষাও আছে। এরা মাঝে মাঝে নেতার বড়াই করে। বলে তাদের নেতা এখন পড়াশুনা করেন, আবার কেউ কেউ বাড়িয়ে বলে তিনি ব্যারিস্টার হচ্ছেন। ব্যারিস্টার হতে হলে সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাস নিজের মতো করে শিখতে হয়। তাও রাজনীতির ইতিহাস, দেশের ইতিহাস, বাবার ইতিহাস ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি শিখছেনও। সম্ভবত বিলেতে এসে কোন দৈবপাকে কিছু বই পেয়ে গেছেন, যেখানে তার বাবা বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। যে কোনো সন্তানই তার বাবাকে নিয়ে গর্ব করে। এটাই অনিবার্য সত্য কথা। স্বাভাবিকভাবে তিনিও করেন। আর সে জন্যই তিনি তার গর্বের মাত্রা এই পর্যায়ে নিয়ে তুলেছেন যে, ইতিহাস নিজেই বানিয়ে দিয়েছেন আর আমার বন্ধুস্থানীয় কর্মীরা দ্বিধাদ্ব›দ্ব নিয়ে তারই চর্বিত চর্বণ করে সারা ব্রিটেনের পাশাপাশি পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন নেতার তৈরি ইতিহাস। এই ব্রিটেনে আসার পর প্রথম দুয়েক বছর তিনি কর্মী-সমক্ষে না এলেও এখন খুব ঘন ঘন আসেন। নতুন ইতিহাসের পাঠ নিয়ে তিনি কর্মীদের সবক দেন। তার বাবা স্বাধীনতার ঘোষক সেটা অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতির ধোঁয়ায় অনেক আগ থেকেই তারা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি নতুন করে আবার পাঠোদ্ধার করে তার কর্মীদের পাঠ করার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুকে বললেন ব্যর্থ রাজনীতিক। হায়রে অকাল কুষ্মাণ্ড। বয়স হিসেবে তিনিতো পরিপক্ক মানুষ কিন্তু কেন যেন রাজনীতিতে এত অকালের মানুষ হলেন তিনি, তা বোঝার সাধ্য কি বাংলাদেশের মানুষের নেই? পাকিস্তানের প্রতি প্রীতি আছে তার দলের সেটা আমরা জানি। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্তদের নিয়ে পাকিস্তানিদের বাড়াবাড়ি বিবৃতি বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করছে। জানি না সে কারণেই না-কি এখন পাকিস্তানকে আর বন্ধু হিসেবে নিতে পারছেন না তিনি কিংবা তার দল। সে জন্যই কি বঙ্গবন্ধুর ওপর পাকবন্ধুর একটা অপবাদ দিয়ে তিনি কিংবা তার দলকে ক্লিন করতে চাইছেন। বাংলাদেশের তো বটেই, পৃথিবীর কোনো মানুষই যারা বাংলাদেশের উত্থান সম্পর্কে জানে, তারা কেউই অন্তত বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে ভাবতেই পারবে না। কারণ বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা একটা অঝর কবিতা ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। একাত্তরের যুদ্ধ, লাখ লাখ মানুষের আত্মাহুতি- এই অক্ষয় শব্দগুলোই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস।

একটা কথা বলতেই হয়, তারেক তার এ কথা দিয়ে বুঝিয়েছেন আসলেই পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য একটা রাজনৈতিক গালিই। ‘পাকবন্ধু’ শব্দটি দিয়ে তিনি সরাসরি বলে দিলেন, পাক অর্থাৎ পাকিস্তান এই ঘৃণিত দেশটার বন্ধু ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যাক, অন্তত বোধোদয় হয়েছে তার। পাকিস্তানের বন্ধুদের তিনি ঘৃণা করতে শিখেছেন। সে জন্যই বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে যে নিন্দা কিংবা রাজনৈতিক ঘৃণা কুড়িয়েছেন, তা এখন বঙ্গবন্ধুর ওপর দিয়ে ঝেরে ফেলতে চাইছেন। তাইতো তার ঘৃণিত উচ্চারণ ‘পাকবন্ধু’। অনেকেই বলেন এরকম কথাগুলো নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হবে। প্রতিক্রিয়া বলতে আমরা লিখছি, টিভি প্রচার করছে, আওয়ামী লীগ রাজপথে বক্তৃতা দিচ্ছে। রাস্তার কোনো লোক অবশ্য এ কথাগুলো বললে কেউ লুফে নিতো না। লুফে নিয়েছে সে জন্য, কারণ তারেক রহমান বলেছেন এ কথাটি। তারেক রহমানের অনুসারীরা তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। আমরা বলছি সে কারণে, যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েই যান, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস কি হবে এই ভেবে। দীর্ঘদিন থেকে লন্ডনে বসে ইতিহাসের নতুন নতুন মনগড়া তথ্য হাজির করছেন তারেক। একেকটা সভায় দেশের বিভিন্ন শহর থেকে কর্মীরা যাচ্ছেন এবং তাদের তিনি এই বিকৃত তথ্য মুখস্থ করার জন্য নসিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন। যদি কোনো কারণেই তিনি ক্ষমতার কর্ণধার হয়ে যান, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস যে পাল্টে যাবেই, সেটা তো তিনি বলেই বেড়াচ্ছেন।

তিন. তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের ছেলে হিসেবে রাজনীতিতে আসতেই পারেন, যেমন আসছেন সজিব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র হিসেবে। রাজনীতিতে বাংলাদেশের এ ধারা সহসাই বন্ধ হবে না। আওয়ামী ঘরানায় কিংবা জাতীয়তাবাদী চেতনায় তারা দুজনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন। জয় রাজনীতিতে নতুন, সে জন্যই হয়ত দুয়েকবার বেফাঁস কথা বলেছেন ইতোপূর্বে। আর তারেক পুরনো নেতা। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশে ছিলেন এক সময়ের দুর্নীতির বরপুত্র। সে কারণেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা এখনো তার হাতের মুঠোয়। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা তারেকের কথাগুলোকে বাণী হিসেবেই ধরে নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়ত দলীয় সমর্থকরা অনেক সময় নেতাদের আজগুবি তথ্য বিশ্বাস করে না। কিন্তু দলীয় দায় থেকে তাদের কথাগুলো বেদবাক্যের মতো মেনে নিতেই হয়। কারণ রাজনীতিতে টিকে থাকার আবশ্যকীয় শর্ত যেন তা-ই। নেতাদের বিশ্বাস করতে হবে এবং তা অন্ধভাবে। কিন্তু দুজনের যে কেউই যদি ইতিহাস নিয়ে বিকৃত তথ্য দেন, তাহলে এই বিকৃত তথ্যগুলো আলোচনায় আসবেই। বিপ্লব সে তো দূরের ব্যাপার, দৈবপাকে যদি কিছু না হয়, তবে এরাই তো বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে আগামীর দিনগুলোতে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৪

===========================

লিখেছেন নীড় সন্ধানী

আইকনের টানাটানির ফাঁসে আটকে পড়েছে সমগ্র জাতি। আইকনে আইকনে দড়ি টানাটানি, নাভিশ্বাস বাংলাদেশের। বাংলাদেশের প্রধান দুটো আইকন বিএনপি আর আওয়ামী লীগ। এর বাইরে আছে বিএনপি ছাতার অপশক্তি জামাতে ইসলামী যারা গ্রাস করছে স্বয়ং নিজের ছাতার আইকনকে। অন্যদিকে আওয়ামী ছাতার নীচে আছে বিশ্ববেহায়া এরশাদের জাতীয় পার্টি যারা পেণ্ডুলামের মতো সকাল বিকাল দুই আইকনের দিকে দুলতে থাকে। তার বাইরে বামসহ যেসব খুচরো ইসলামী দল আছে তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভাগ হয়ে ভিড়ে গেছে দুই আইকনের দলে। দুই আইকনের বাইরে আছে কি ছক্কা ছয়ফুর? কিন্তু তার খবর আমরা জানি না বহুবছর(*ছক্কা ছয়ফুর সিলেট থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিল এরশাদের আমলে, ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা হাসিনাকে বোরকা পরাবার প্রতিশ্রুতি ছিল যার)। আইকনে আইকনে এই দড়ি টানাটানির ভগবানের নাম কি কেউ জানে?