নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে মৎস্য দস্যুরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত ১২ জুন থেকে শুরু হওয়া প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের শ্রোতের পানিতে সৃষ্ট বন্যার পর পানি কমে গেলে হালদা নদীতে ভাসা জাল বসিয়ে ও হাত জাল দিয়ে শত শত লোক মাছ শিকারের মহোৎসব পালন করছে। অসাধু মৎস্য দস্যুরা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে দিনে-রাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জাল ফেতে প্রতিদিন দিনে-রাতে কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ, গলদা চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মা মাছ শিকার করছে। এতে হালদার মা মাছ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রজনন হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। এতে করে প্রজনন স্থল হালদায় মৎস্য অভয়ারন্য আইন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর এই নিয়ে সংশি¬ষ্ট মৎস্য অফিসের কর্মকর্তারা নদীতে বিভিন্ন সময় অভিযান চালালেও মৎস্য দস্যুদের রোধ করা যাচ্ছে না বলে তারা নির্বিকার হয়ে পড়েছে।

মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, হালদা নদীতে প্রতি বছর এপ্রিল-জুন মাসের যে কোন সময় প্রবল বর্ষণ ও মেঘের গর্জনের ফলে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে নদীতে সৃষ্ট স্রোতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছের নিরাপদ চলাচল করতে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রানালয় ২০০৭ সালে ২ জুলাই এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী হালদা নদীর সর্তার ঘাট ব্রিজ থেকে মদুনাঘাট ব্রিজ পর্যন্ত ২০ কি: মি: এলাকাকে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হয়েছিল। ঞযব চৎড়ঃবপঃরড়হ ধহফ ঈড়হংবৎাধঃরড়হ ড়ভ ঋরংয জঁষবং ১৯৮৫ অনুযায়ী এ এলাকা থেকে সারা বছর মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা একই সময়ে বাংলাদেশে গেজেটে প্রকাশিত হয়। হালদা নদীতে নির্বিচারে মাছ আহরণ বন্ধ তথা প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ধরা বন্ধের লক্ষ্যে এবং নদীর উৎপাদিত পোনা বড় হয়ে ব্রুড মাছে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিতে এই অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ২০১০ সালে সর্তার ঘাট ব্রিজ থেকে মদুনাঘাট ব্রিজ পর্যন্ত ২০ কি: মি: এলাকাটিকে বৃদ্ধি করে নাজিরহাট এলাকা থেকে মদুনাঘাট হালদা নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদীতে সারা বৎসর মাছ শিকার নিষিদ্ধ করে মৎস মন্ত্রনালয়।

হালদা পাড়ের স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নদীর তীরবর্তী অসাধু মৎস্য দস্যুরা আইন মানছে না। তারা সুযোগ পেলে দিনের বেলায় ও রাতের আধারে প্রতিদিন ভাসা জাল, হাত জাল ও বড়শী দিয়ে মা-মাছ শিকার করছে হালদা নদী থেকে। কয়েক দিন যাবৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া এই প্রতিবেদককে জানান, হালদার মুখে কর্ণফুলী নদী হওয়ায় সাগরের লবণাক্ত পানির প্রভাবে হালদাতে প্রচুর পোনা মারা গিয়ে প্রতি বছরই কমছে মাছের ডিম। এক সময় প্রতি মৌসুমে হালদা থেকে ৫ হাজার কোটি পর্যন্ত মাছের ডিম পাওয়া গেলেও তা কমে ২৫০/৩০০ হাটহাজারী ও রাউজানের হালদা নদীর দুই অংশের নদিমপুর, ইন্দ্বিরা ঘাট, উরকিরচর, মইশকরম, কাগতিয়া, বিনাজুরি, খলিপার ঘোনা, বাড়িয়া ঘোনা, নাফিতের ঘাট, আমতোয়া, কোতোয়ালী ঘোনা, পশ্চিম গহিরা, বদুর ঘোনা, দক্ষিন গহিরা, মোবারক খীল, কাসেম নগর, আজিমার ঘাট, মগদাই, অংকুরী ঘোনা, রামদাশ হাট, কাগতিয়া, পশ্চিম আবুর খীল, সার্কদা, মোকামী পাড়া, কঢ়ুখাইন, গড়দুয়ারা নয়াহাট, পুরালিয়া খাল হতে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে অবাধে মা মাছ শিকার চলছে। আর এ সুযোগে মৎস্য দস্যুরা দেদারে জাল পেলে মা-মাছ নিধন করছে।

এদিকে, গত বুধবার (২০ জুন) হালদা নদী থেকে মাছ শিকার করার সংবাদ পেয়ে রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যজিষ্ট্রেট শামীম হোসেন রেজা উপজেলা মৎস অফিসার আমিনুল ইসলামকে সাথে নিয়ে রাউজান থানা পুলিশের সহাযোহিতায় অভিযান চালিয়ে নদীতে জাল দিয়ে মাছ শিকার করার সময় ১ হাজার মিটার জাল উদ্বার, মাছ শিকার করার কাজে ব্যবহারের ৩টি নৌকা জব্দ¦ এবং ২ জনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে। এছাড়া আরো আটককৃত ৮ জনের মধ্যে ১ জনকে ১ বৎসর, ৩ জনকে ৬ মাস, ১ জনকে ২ মাস, ২ জনকে ১ মাস করে বিনাশ্রম কারাদ- প্রদান করে।

অন্যদিকে হাটহাজারী উপজেলায় এখনও পর্যন্ত এমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন না করায় শাহ মাদারী খাল, কাটাখালি খাল, আজিমের ঘাটসহ আরো বেশ কয়েকতটি স্পটে হালদার মোহনায় কারেন্ট জাল বসিয়ে ও হাত জাল দিয়ে শত শত লোক মাছ শিকারের মহোৎসব পালন করছে বলে জানান আমিন মুন্না নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোমিনুল হক এর মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি একটি মিটিং (সভা) আছেন বলে জানান। তবে বিষয়টি এ প্রতিবেদককের কাছ থেকে অবহিত হয়ে হালদার মোহনায় ভাসা জাল বসিয়ে ও হাত জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে যেসব এলাকায় লোক পাঠানো হয়েছে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল আলম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া এই প্রতিবেদককে জানান, এভাবে মৎস্য দস্যুদের মাছ নিধন অব্যাহত হালদার মা মাছ টিকিয়ে রাখা দূ:স্কর হবে। রাতে নদীতে যখন সর্বনিন্ম ভাঁটা শুরু হয় তখন এক শ্রেণির মৎস্য দস্যুরা বেপরোয়া হয়ে ভাসা জাল ফেতে মা-মাছ ধরে। এমন অবস্থা সংশি¬ষ্ট প্রসাশনকে রাতে হালদায় অভিযান পরিচালনা করতে হবে। যদিও তাও সম্ভব না হয় তাহলে নদী পাহারাদারকে আরে সক্রিয় করে পাহারা জোরদার করতে হবে। তবে উপজেলা মৎস্য হালদায় বিভিন্ন সময় হালদা নদীর বিভিন্ন স্পটে অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার মিটার ঘের জাল ও কারেন্ট জাল আটক করে। তবুও মৎস্য দস্যুরা সংশি¬ষ্ট প্রশাসনের কর্তাদের চোখ ফাকিঁ দিয়ে দেদারে মাছ শিকার অব্যাহত রেখেছে।প্রসঙ্গত, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র মিঠা পানির এই হালদা নদী বিশ্বের একমাত্র অন্যতম জোয়ার-ভাঁটার নদী। এখানে প্রতি বছর এই সময়ে কার্প জাতীয় রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছের নিষিক্ত ডিম ছাড়ে এবং জেলেরা ডিম সংগ্রহ করে পরে তা কয়েক দফায় বিকিকিনি করে কোটি কোটি টাকা আয় করে। অপার এই জীব বৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদের অন্যতম রূপালী খনি জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখে চলেছে বহু বছর ধরে।