মালয়েশিয়ায় ১০ বছরের বেশি কেউ ভিসা পাবেন না।ইতিমধ্যে যারা ১১ ও ১২তম ভিসা (স্টিকার) পেয়েছেন, সেগুলোও বাতিল করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ।২২ জুন দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ এ বিষয়ে একটি নোটিশ জারি করেছে। নোটিশে বলা হয়েছে- ১১ ও ১২ নম্বর ভিসাপ্রাপ্তদেরও দেশে ফেরত যেতে হবে। ইমিগ্রেশন বিভাগের এমন ঘোষণায় বিদেশি কর্মীরা পড়েছেন বিপাকে।

এসব বিদেশি কর্মীর মধ্যে দেশে ফিরতে হবে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশিকে। এদিকে মালয়েশিয়ায় নতুন শ্রমিক নিয়োগ সাময়িক স্থগিত করার পর পরই সরকারের এমন ঘোষণায় বিদেশি কর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালের কলিং ভিসায় যারা মালয়েশিয়া এসেছেন, তারা এর আওতায় পড়েছেন।

এদিকে দেশটির অভিবাসন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে জুলাই মাস থেকে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করবে দেশটির প্রশাসন।২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে চালু হওয়া বৈধকরণ প্রকল্পে যেসব কর্মী ও নিয়োগকর্তা নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের আটক করাই এ অভিযানের প্রথম লক্ষ্য- সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক সেরি মুস্তাফার আলি এ হুশিয়ারি দিয়েছেন। যারা অবৈধভাবে কর্মরত রয়েছেন, তাদের আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে ‘থ্রি প্লাস ওয়ান’-এর আওতায় তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে নিয়োগকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।এদিকে দেশটির বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, এ সংখ্যা ৪ লাখের বেশি।উপার্জন ভালো হওয়ায় ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন না করেই থেকে যাচ্ছেন অনেকে।আকাশ, সমুদ্র বা স্থলপথে যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় উন্নত দেশগুলোর মতোই সুবিধা রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায়। তাই দুই যুগ আগে থেকেই আশপাশের বিভিন্ন দেশের জন্য অন্যতম শ্রমবাজার এটি। পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ও পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটায় অনেক পর্যটকের আগ্রহ মালয়েশিয়ার দিকে।বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত প্রবাসীরা দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর অমানবিকভাবে একঘরে গাদাগাদি করে রাতযাপন করেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা।

তারা জানান, পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে এভাবে পড়ে আছেন প্রবাসে। সামান্য কিছু বাড়তি আয়ের আশায় রাতভর কাজ করছেন অনেকেই।আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অবদান যেমন রয়েছে, সেই সঙ্গে অবৈধ প্রবেশ এবং থেকে যাওয়াসহ নানা কার্যকলাপে ক্ষুণœ হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। তাই এসব বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি- এমনটিই মত সংশ্লিষ্টদের।

দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান শুক্রবার মালয়েশিয়াভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য স্টারকে বলেন, এই স্থগিতাদেশ তত দিন পর্যন্ত চলবে, যত দিন না বাংলাদেশের কর্মীদের মানব পাচারের যে পদ্ধতিতে নিপীড়ন চলছে-এমন অভিযোগের একটা পূর্ণ তদন্ত হচ্ছে।২০১৬ সালে মালয়েশিয়া যেতে নতুন পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের ১০টি এজেন্সিকে মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারণ করে দেয় সে দেশে অভিবাসন শ্রমিক পাঠাতে। এর আগে বাংলাদেশ থেকে যেকোনো রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারত। এটি ছিল পুরোনো পদ্ধতি।বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর চলতি পদ্ধতিকে ‘পুরো জগাখিচুড়ি’ অভিযোগ করে এম কুলাসেগারান বলেন, কর্মী নেওয়ার পদ্ধতিটি একটা ব্যবসায় পরিণত করে ফেলেছে। তাতে কিছু মানুষের লাভ হচ্ছে। মালয়েশিয়া যেতে অভিবাসী কর্মীদের দুই দেশের মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল পরিমাণের গলাকাটা টাকা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশি যে ১০ এজেন্সি এই সংঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত, তাও স্থগিত করা হলো।

এদিকে, মালয়েশিয়াভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য স্টার গতকাল এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মানব পাচারের একটি সংঘবদ্ধ চক্র গত দুই বছরে প্রায় এক লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। এসব বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে ওই চক্রটি প্রায় ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।২০১৬ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া এই পদ্ধতিতে এক লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। আরও এক লাখের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যেককে স্থানীয় দালালদের ৪ লাখ ১৯ হাজার ৮৪৫ টাকা (মালেশিয়ান ২০ হাজার রিঙ্গিত) দিতে হয়। অভিবাসী কর্মীদের কাজের অনুমতিপত্র (ওয়ার্ক পারমিট) ও টিকিট বাবদ দালালেরা পুরো টাকার অর্ধেক পরিমাণ ‘সিন্ডিকেট চক্র’কে দিয়ে দেয়।অনুসন্ধানী ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর এই চক্রের হোতার নাম ‘ডাতুক সেরি’ (এর বাংলা মানে জনাব/সাহেব)।মালেশিয়ানদের কাছে এটি একটি সম্মানসূচক সম্বোধন। এই হোতাই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিলিয়ন রিঙ্গিতের মানব পাচার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চক্রটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। মূল হোতা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ-দুই দেশেই শক্ত রাজনৈতিক প্রভাব আছে। ২০১৬ সালে এই ব্যবসায়ী দুই দেশের সরকারের এক চুক্তিতে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই চুক্তির ফলে মাত্র ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়। এই চুক্তির ফলে প্রায় ১ হাজার ৫০০ রিক্রুটমেন্ট এজেন্ট মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

দ্য স্টার-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে, ওই ১০ এজেন্সির মধ্যে কয়েকটি এজেন্ট বাংলাদেশি কর্মী ও মালয়েশিয়ায় নিয়োগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে শুধু টাকা আয় করতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের পাঠাচ্ছে। মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যেক বাংলাদেশির কাছ থেকে নিবন্ধন থেকে পরিবহন বাবদ ২০ হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা) নেওয়া হচ্ছে। অথচ রিক্রুটিং এজেন্টদের মাথাপিছু খরচ হয় ২ হাজারের কম রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ৪২ হাজার ১৮১ টাকা)।ডাতুক সেরি এক মালয়েশিয়ান নারীকে বিয়ে করেছেন ১৫ বছর আগে। দ্য স্টার-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই টাকা নিয়ে ডাতুক সেরি, তাঁর সহযোগী ও বন্ধুরা আরও ধনী হচ্ছেন। এই টাকার একটা অংশ তিনি দুই দেশের রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভাগ করে দিচ্ছেন।