৫২.৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তুরস্কে প্রথম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন প্রায় ১৬ বছর শাসনক্ষমতায় থাকা রজব তায়্যিব এরদোয়ান। তার জোটের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া তুর্কি জনগণের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয় ৪৭.৫ শতাংশ। তুর্কি ও কুর্দি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষের বিষাক্ত বীজ ছড়িয়ে তিনি দেশে বিভাজন বাড়িয়েছেন। নিজের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে একক ক্ষমতাধর ও নিরঙ্কুশ এক রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি বিভক্তির রাজনীতিকে পোক্ত করেছেন দিনকে দিন। তার বিজয়েও তাই তুরস্কের জনগণের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সমর্থকদের কাছে এরদোয়ান খুবই আস্থাভাজন, একেবারে বিশ্বনেতা হওয়ার যোগ্যতা-সম্পন্ন। তারা মনে করে, তার হাত ধরেই বিশ্বে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নেবে তুরস্ক। বিরোধীরা এরদোয়ানের নিরঙ্কুশ সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রাপ্তিতে ভীত। তাদের আশঙ্কা, সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থায় যাওয়া তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করবেন। সেখানে বহুপক্ষের মতের প্রতিফলন ঘটবে না। ‘এক ব্যক্তির শাসনের’ বিলোপ কামনা করেন তারা।

২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এরদোয়ান। ২০১৪ সালেই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন। তার প্রধান সমর্থক হচ্ছেন রক্ষণশীল এবং ধার্মিক অপেক্ষাকৃত বয়স্ক তুর্কিরা। ২০১৬ সালের এক ‘ব্যর্থ গণঅভ্যুত্থানের’ পর ২০১৭ সালে এক গণভোটে সামান্য ব্যবধানে জয়লাভ করেন এরদোয়ান। এতে তিনি দেশটিকে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে জনরায় পান। রবিবারের নির্বাচনেও জয় পান এরদোয়ান। এর মধ্য দিয়ে নির্বাহী ক্ষমতা পাচ্ছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরদোয়ান সরকারি কর্মকর্তা, ভাইস প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীদের নিয়োগ দেবেন এবং যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন। সংশোধিত সংবিধানে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন তিনি।

নিজ দল একেপি পার্টির সদস্যরা বলছে, এরদোয়ানকে তাদের সমর্থনের কারণ হলো তিনি আস্থাভাজন। তাদের বিশ্বাস, অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটানোর মধ্য দিয়ে এরদোয়ান দক্ষতার সঙ্গে তুরস্ককে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সমর্থকদের দাবি, ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকাকালীন এরদোয়ান দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছেন এবং বিশ্বে তুরস্কের একটি ভালো অবস্থান তৈরি করেছেন। মুসলিমদের স্বার্থ সুরক্ষায় তার ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন তারা। আয়হান বলেন, ‘তিনি (এরদোয়ান) মার্জিত, তবে তুরস্কের শত্রুদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর।’

এরদোয়ান যখন ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন, তখন তার চুল কেটে দিতেন ইয়াসার আয়হান। তার সেলুনটি ছিল কাসিমপাসা এলাকায়। এরদোয়ানের সঙ্গে তার তোলা একটি ছবি এখনও ঝুলছে তার সেলুনে। এ কাসিমপাসা এলাকাতেই বড় হয়েছেন এরদোয়ান। ৫২ বছর বয়সী আয়হান এরদোয়ানকে ভোট দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। তিনি কেবল একজন নেতাই নন, তিনি বিশ্বনেতা।’ রজব নামে ৩৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তিনিও রবিবার (২৪ জুন) অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছেন; কারণ তিনি ও এরদোয়ান একই এলাকার মানুষ। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে ভোট দিলেও একইদিন অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন অন্য দলকে। এরদোয়ানের দল একপিকে ভোট না দিয়ে সাদের পার্টিকে ভোট দিয়েছেন তিনি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাকে জোর দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল দলটি। রজবের মতে, একেপি দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা দক্ষ নন, কারণ তারা দুর্নীতিবাজ।

এরদোয়ান আগাম নির্বাচনের ডাক দেওয়ার পর পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশই মনে করেছিলেন, সামনের দিনগুলোতে তুরস্কের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। অর্থনৈতিক বিপর্যয় প্রতিহতকরণ, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা মোকাবিলায়, বিদেশি বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে এবং তুরস্কের মুদ্রা লিরার পতন ঠেকানোর প্রতিশ্রুতিকে নির্বাচনী প্রচারণার উপজীব্য করেছিলেন এরদোয়ান। তবে সংশোধিত সংবিধানের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পথ রচনার পাশাপাশি ব্যর্থ অভ্যুত্থানকে বিরোধী দমনের হাতিয়ার হিসেবে এখনও ব্যবহার করে আসছেন এরদোয়ান। সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী থেকে বিরোধী দলীয় নেতৃত্বসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আর সংবাদমাধ্যমে কর্মরত বিভিন্ন পেশাজীবী তার রোষানলে পড়েছে। এখনও সেটাকে আটক আছে বহু মানুষ। এরদোয়ানের বিরোধীরা বলছে, তারা বিরোধী দলগুলোকে ভোট দিয়েছে। কারণ তারা দেশে ‘এক ব্যক্তির শাসন’ এর সমাপ্তি চায়। আরও বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চায় তারা। তবে গত বছর অনুষ্ঠিত গণভোটের রায় অনুযায়ী, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আরও নতুন নতুন ক্ষমতার অধিকারী হতে যাচ্ছেন।

চিহাঙ্গির এলাকার ভোটাররা বলছেন, ‘এক ব্যক্তির শাসনের’ বিরুদ্ধে ভোট দিতে এসেছেন তারা। ফুলিয়া নামে ৩৯ বছর বয়সী এক তুর্কি নারী বলেন, তার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে। অক্সিজেন ট্যাংকের সহায়তায় শ্বাস নিতে নিতেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন তিনি। ভোট দিতে এসে ফুলিয়া জানান, এরদোয়ান জেতার পর যে অতিরিক্ত ক্ষমতা পাবেন তা নিয়ে শঙ্কিত বোধ করছেন। প্রেসিডেন্টের এ ধরনের চরম ক্ষমতাপ্রাপ্তির বিরোধী তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে ফুলিয়া বলেন, “আমরা সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরে পেতে চাই। আমরা ‘এক ব্যক্তির শাসনের’ বিরোধী। প্রত্যেককে উপস্থাপন করতে হবে। আমি এবারের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হয়েছি, কারণ রাজবন্দি হিসেবে এক প্রার্থীকে কারাগারে রাখা হয়েছে।

ফুলিয়ার অক্সিজেন ট্যাংকটি বহন করে এনেছেন তার ৪৫ বছর বয়সী বন্ধু হাকান। নির্বাচন নিয়ে জানতে চাওয়া হলে হাকান দাবি করেন, তিনি ‘স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে’। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর ধরে আমি আশাবাদী ছিলাম না। এ প্রথম আমি আশাবাদী হয়েছি।’ বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন মুহাররেম ইনচে। আঙ্কারা, ইজমির ও ইস্তানবুলে লাখ লাখ ভোটারকে কাছে টানতে পেরেছেন তিনি। শনিবার (২৩ জুন) তার একটি জনসভায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নেয়। রবিবার (২৪ জুন) ইনচেকে ভোট দিতে মেয়ের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে আসেন ৯৩ বছর বয়সী রেসিট। তিনি বলেন, ‘ভোট দেওয়াটা আমাদের দায়িত্ব।’