হাইকোর্টের মন্তব্য, প্রতিটি বিয়েবিচ্ছেদের কারণে সন্তানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সন্তান কখনোই মা-বাবার বিচ্ছেদ চায় না। সারাদেশে ডিভোর্স হওয়া দম্পতিদের সব সন্তানের অনুভূতি একই। তাদের মধ্যে কেউ তা প্রকাশ করতে পারে, কেউ তা প্রকাশের সুযোগ পায় না। দুই ছেলে ধ্রুব (১২) ও লুব্ধককে (৯) নিজের কাছে রাখতে চেয়ে কামরুন নাহার মল্লিকার আবেদনের বিষয়ে বুধবার (৪ জুলাই) শুনানিকালে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।

আদালতে দুই ছেলের মা কামরুন নাহারের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ। অন্যদিকে ধ্রুব ও লুব্ধকের বাবা মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।

ধ্রুব ও লুব্ধককে উদাহরণ হিসেবে এনে হাইকোর্ট বলেন, ‘এ দুটি বাচ্চা আমাদের কাছে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। এ ধরনের অনেক পরিবারের (ডিভোর্স হওয়া) কোনও শিশু হয়তো তার চাওয়ার কথা প্রকাশ করতে পারে, কোনও শিশু হয়তো প্রকাশের সুযোগ পায় না। ধ্রুব ও লুব্ধকের বাবা-মা শুনলেও অন্য বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের অনুভূতি কানে নিচ্ছেন না।’

বুধবার শুনানির শুরুতে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের কাছে আদালত জানতে চান, পরিস্থিতির কি কোনও উন্নতি হয়েছে? বাবার আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, ‘হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। ছোট ছেলে লুব্ধক তার বাবাকে একদিন রাতে বাসায় থেকে যাওয়ার আবদার জানায়। বাবা রাজি হলেও মা তাতে সায় দেননি। এ কারণে সেদিন রাত ১টায় বৃষ্টির মধ্যেই মেহেদী হাসানকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল।’

আইনজীবী তাপস কান্তির অনুরোধ, ‘দুই সন্তান যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রয়োজনে তিনি ড্রয়িং রুমে থাকবেন।’ আদালত তখন বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন সবকিছুই হবে।’

পারিবারিক সমস্যার কারণে ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ার কারণে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে ধ্রুব ও লুব্ধকের বাবা মেহেদী হাসানের চাকরি চলে যায়। পারিবারিক এই ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে আদালত বলেন, ‘এই ঘটনা মিডিয়ায় কীভাবে এসেছে দেখেছেন? জনগণের সেন্টিমেন্ট দেখেছেন? এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল আদালতকে জানান, মেহেদী হাসান সারেন্ডার করেছেন। দুই সন্তান যেভাবে চাইবে তিনি তাই করবেন। আদালত তখন প্রশ্ন করেন, ‘এটাকে কি পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?’ তাপস কান্তির উত্তর, ‘কিছু তো উন্নতি হয়েছে।’ তখন কামরুন নাহারের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। সুতরাং দু’জনের মধ্যেই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য আরও সময় লাগবে।” এতে একমত হয়ে আদালত বলেন, ‘ঠিক। এটা তো রাতারাতি উন্নতি হবে না।’

দুই শিশুকে সামনে ডেকে তাদের খোঁজ-খবর নেন আদালত। বড় ছেলে ধ্রুবকে আদালত জিজ্ঞাসা করেন, ফুটবল বিশ্বকাপে তুমি কোন দল করো? তার জবাব, ‘ব্রাজিলকে সাপোর্ট করি।’ এরপর আদালত ছোট ছেলে লুব্ধককে (৯) জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কোন দল করো? উত্তরে সে নিজেকে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার উল্লেখ করে। এরপর আদালতের প্রশ্ন, ‘সবকিছু ভালো আছে তো?’ লুব্ধক জবাব দেয়, ‘সবকিছু ভালো আছে।’

আইনজীবী কাজলের ভাষ্য, ‘ধ্রুব ও লুব্ধক ইতোমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তারা খুশি। প্রতিদিন স্কুলে আনা-নেওয়া করছেন তাদের মা।’ এসব তথ্য জেনে আদালত বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হয় না।’আদালত জানতে চান, নতুন স্কুল কেমন লাগছে? ধ্রুব বলে, ‘ভালোই।’ আদালতের প্রশ্ন, তোমরা ঘুরতে গিয়েছিলে? ধ্রুব বলে, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।’ কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে, আদালত জানতে চাইলে ধ্রুব জায়গার নাম মনে করতে পারেনি। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি জানান, মা ছুটি নিয়ে ঘুরছেন। বাবাও ছেলেদের নিয়ে ঘুরতে যেতে চান। আদালত তখন বলেন, ‘বাবাও ঘুরতে পারবেন। প্রয়োজনে তাদের মাকেও সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন।’

এই ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহারকে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই বলেছেন, ‘তোমরা পূণ্যের কাজ করেছো।’ এ তথ্য জানিয়ে আইনজীবী কাজল বলেন, ‘আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চাশা বেড়ে গেছে। সমঝোতার জন্য সময় দিয়ে শিশুদের কল্যাণের কথা ভেবে পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার বার্তা দিয়েছেন কোর্ট।’

একইসঙ্গে মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহার দম্পতিকে সতর্ক করেছেন আইনজীবী কাজল। তার কথায়, ‘উভয় পক্ষকে মনে রাখতে হবে, আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্যকিছু ভেবে থাকেন, তাহলে তা ঠিক হবে না। আদালতের হাত খাটো নয়। সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবে আদালত যে কোনও আদেশ দিতে পারেন।’

এ সময় বাবা-মাকে ডেকে আদালত তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা উভয়ে শিক্ষিত। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।’

এরপর আদালত আদেশ দিয়ে বলেন, ‘মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহারের নিজেদের মধ্যে সমঝোতা প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতির জন্য দুই পক্ষ সময় চেয়েছে। সময় মঞ্জুর হয়েছে। এ মামলার পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ধার্য করা হলো।নিজেদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে ধ্রুব ও লুব্ধকের বাবা-মাকে ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন আদালত। তালাক হয়ে যাওয়ার পরও সন্তানদের কথা বিবেচনা করে মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহার মল্লিকা আবার এক হতে চান কিনা এবং এ ব্যাপারে কী কী অগ্রগতি হয়েছে সেই বিষয়ে আদালতকে জানাতে হবে তাদের।