চিকিৎসার ‘অবহেলায়’ শিশু মৃত্যুর ঘটনায় আলোচিত চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়মের ‘প্রমাণ’ পাওয়ার পর ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে এই অভিযানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি হিসেবে ডা. দেওয়ান মাহমুদ মেহেদি হাসানও উপস্থিত ছিলেন।

অভিযানে ম্যাক্সের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে ব্যবহৃত উপকরণ, ওষুধ এবং হাসপাতালের নথিপত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগপত্র পরীক্ষা করে দেখা হয় বলে র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মিমতানুর রহমান জানান।অভিযান শেষে বিকালে শহরের মেহেদীবাগ এলাকার ম্যাক্স হাসপাতালের নিচতলায় এক ব্রিফিংয়ে সারোয়ার আলম বলেন, অভিযানে তারা ম্যাক্স হাসপাতালে বিভিন্ন রকমের অনিয়ম ও গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছেন।দশ লাখ টাকা জরিমানা করার পাশাপাশি গাফিলতি সংশোধনের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।অভিযানে পাওয়া অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ম্যাক্স হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবে যথেষ্ট দক্ষ জনবল নেই। বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে এইচএসসি পাস লোকজন চাকরি করছে। এখানে মিনিমাম স্নাতক ডিগ্রিধারী বা বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্নদের কাজ করার কথা। এখানে বায়োকেমিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্টও নেই।একটি হাসপাতাল চালাতে হলে নমুনা পরীক্ষার নিজস্ব ব্যবস্থা থাকার নিয়ম থাকলেও মাক্সে সে নিয়ম অনুসরণ করা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন স্যাম্পল কালেকশন করে তারা চট্টগ্রাম ও দেশের বাইরের বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিজেদের নামে রিপোর্ট দেয়। অনেকটা কমিশন এজেন্টের মত তারা কাজ করে।

ম্যাক্সের ল্যাবে এপিক হেলথ কেয়ার, ল্যাব এইড, পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টার, ডা. লাল প্যাথ ল্যাব, প্যাথ কেয়ার ল্যাব ও সিগমা ল্যাব লিমিটেডে করানো বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে বলেও জানান এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।তিনি বলেন, দেশের বাইরে স্যাম্পল পাঠাতে সরকারি অনুমোদন লাগে। ম্যাক্স কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই নমুনা বিদেশে পাঠিয়ে আসছিল।ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, মাক্সের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট পওয়া গেছে; আর অপারেশন থিয়েটারে মিলেছে কিছু অনুমোদনহীন ওষুধ। কিছু সার্জিক্যাল আইটেমেরও মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।ম্যাক্সের ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেলেও তারা নিয়ম ভেঙে ওষুধ বিক্রি করে আসছিল বলে জানান ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ডা. দেওয়ান মাহমুদ মেহেদি হাসান ব্রিফিংয়ে বলেন, তদারকি একটি আইনি প্রক্রিয়া। এটা চলমান থাকবে।এদিকে ম্যাক্স হাসপাতালে এই অভিযানের প্রতিবাদে বৃহত্তর চট্টগ্রামে সব বেসরকারি হাসপাতালে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন মালিকরা।দুপুরে নগরীর জিইসি মোড়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয়ে এক সভা শেষে ম্যাক্স হাসপাতালের পরিচালক প্রাইভেট হসপিটাল অ্যান্ড ল্যাব ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. লিয়াকত আলী খান বলেন, হাসপাতালগুলোতে আগেই ভর্তি হওয়া রোগীরা এই ঘোষণার আওতায় পড়বেন না; তাদের চিকিৎসা চলবে।বেসরকারি হাসপাতালে সেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ম্যাক্সের নিচতলায় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, চিকিৎসা পাওয়া সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এটা ব্যাহত করতে চাইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।অভিযান অব্যাহত থাকবে। সরকারের ওপর ক্ষমতাশালী কেউ নয়। সবাই আইন মানতে বাধ্য। প্রয়োজনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দুই একটা বন্ধ হয়ে গেলে মঙ্গল।বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, পলিসি লেভেলে আলোচনা করতে চাইলে সরকারের সাথে করতে পারেন। কিন্তু আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। তদারকিতে বাধা দিতে চাইলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কাউকে সরকার ছিনিমিনি খেলতে দেবে না।দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুবেল খানের আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রাইফা গলায় ব্যথা নিয়ে গত ২৮ জুন বিকালে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ২৯ জুন রাতে তার মৃত্যু হয়।‘ভুল চিকিৎসায়’ তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে বিক্ষোভ করেন সাংবাদিকরা। পরে ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটিও এ ঘটনার তদন্ত করে।
সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাতে তাদের প্রতিবেদন দেয়, যাতে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা এবং গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।ওই প্রতিবেদন আসার পর শিশু ওয়ার্ডে সেদিন দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. দেবাশীষ সেন গুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেবকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে শনিবার জানান হাসপাতালের পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান।সিভিল সার্জনের কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাইফা যখন তীব্র খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয় তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অনভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয় এবং ওই সময়ে থাকা সংশ্লিষ্ট নার্সদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও এ রকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা বা জ্ঞান কোনোটাই তাদের ছিল না।শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরী শিশুটিকে যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করে দেখেননি। ডা. দেবাশীষ সেন গুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেব শিশুটির রোগ জটিলতার বিপদকালীন সময়ে আন্তরিকতার সাথে সেবা প্রদান করেননি বলে শিশুর পিতা-মাতা যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, যাহা এই তিন চিকিৎসকের বেলায় সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।