শরীফুল ইসলাম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট পদে চাকরি করেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দাঁড়িয়ে আছেন কর্মস্থল শ্যামলীতে যাওয়ার জন্য। তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আরো বহু মানুষ। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পেলেন না তাঁরা। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বাস এলে দৌড়ে গেলেন যাত্রীরা। চলন্ত গাড়িতেই ধাক্কাধাক্কি করে যে কজন পারলেন উঠলেন। তাঁদের নিয়েই ছেড়ে গেল বাস।বাকিরা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন চলন্ত বাসের দিকে। আবারও বাসের অপেক্ষা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গণসংবর্ধনা দিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশের জেরে রাজধানীজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আগমণ নির্বিঘœ করতে পুলিশ বেশ কয়েকটি সড়ক বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কিছু কিছু সড়কে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যান চলাচল। ফলে সমাবেশস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের সড়কগুলোতে যানজটের তীব্রতা বেশি দেখা গেছে। এর ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী।

সরেজমিন দেখা গেছে, বিকেল ৩টায় শুরু হওয়া সমাবেশকে কেন্দ্র করে বেলা ১২টার পর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের সড়কগুলোতে দলীয় নেতাকর্মী ও সমাবেশগামী পরিবহনের ভিড় বাড়তে থাকে। সড়কে ঢাকার উপকণ্ঠের বিভিন্ন এলাকা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে আসা নেতাকর্মীদের বহনকারী পরিবহনগুলোর চাপ বাড়তে থাকে। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আসতে থাকে খ- খ- মিছিল। ফলে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। দীর্ঘক্ষণ ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকার পরেও সিগ্যাল ছাড়া হচ্ছে না। যানজট ছড়িয়ে পড়ে পুরো নগরীতে।শনিবার রাজধানীজুড়ে যাত্রীদের এমন অসহায় চিত্রই চোখে পড়ে। পরিবহন সংকটে আজ দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবী হাজারো মানুষ।একই দৃশ্য দেখা গেছে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে গিয়েও। যাত্রী সংখ্যার তুলনায় পরিবহন ছিল একেবারেই অপ্রতুল।গুলিস্থানগামী শিকড় পরিবহনের একটি বাস মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে এসে থামলেই হুড়মুড় করে যাত্রীরা উঠতে থাকেন। বাসের ভেতরে দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র জায়গা নেই, তবুও ঝুলে হলেও যেতে চাইছেন সবাই। রহিম হোসেন নামের একজন বাসে উঠেই বলে উঠলেন, ‘বাস-টাস কি মইরা গেছে নাকি? এভাবে ঠেলাঠেলি করে যাওন যায়! কথা হয় অফিসগামী এমন আরো বেশ কয়েকজনের। তাদের কেউ যাবে কাওরানবাজার, কেউ শহবাগে বারডেম হাসপাতালে, আবার কেউ ফার্মগেট।

কিন্তু হঠাৎ এই পরিবহন সংকট কেন জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী মিরপুর রোডের ১৫ নম্বর বাসের লাইনম্যান বলেন, সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিদিন ৪০টির মতো বাস ছেড়ে যায় যাত্রাবাড়ী থেকে। কিন্তু আজ বাস এসেছে মাত্র চার-পাঁচটি।কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, বাসগুলো মিরপুরে রাখা হয়েছে। জনসভার লোকজন আসা যাওয়ার জন্য সব বাসই আগে থেকেই রিজার্ভ রাখা হয়েছে। আর এতেই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।শিকড় পরিবহনের বাংলা মোটরের ওয়ে বিল কাউন্টার ম্যানেজার মো. সোহেল বলেন, সারাদিনে মোট ৩০টি শিকড় পরিবহনের বাস চলে এই রুটে। কিন্তু সকাল থেকে হিসাব পেয়েছি ১৪টি বাসের। বাকিগুলো জনসভার (গণসংবর্ধনা) কাজে রিজার্ভ করা।

পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহনের ওয়ে বিল কাউন্টারের ম্যানেজার ইউসুফ খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের ১১০টি বাস চলে এই রুটে। তবে এখন পর্যন্ত ৭৫টি বাস পেয়েছি। বাকিগুলো বিভিন্ন কাজে আছে।এসব নিয়ে শিকড় পরিবহনের ম্যানেজার মো. জসিমউদ্দীন সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।তবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহনের ম্যানেজার তহিদুজ্জমান বলেন, অনেকগুলো বাস জুরাইন ও সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছি প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনার লোক নিয়ে আসার জন্য। এই কারণেই রাস্তায় আজকে বাস কম।নানা সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আজ গণসংবর্ধনা দেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য রাজধানীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে শতশত পুলিশ কর্মকর্তা। সকাল ১০টা থেকেই অবস্থান নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। এ ছাড়া বিভিন্ন ভবনের ছাদের উপরেও তাদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে শাহবাগ হতে মৎস্য ভবন, টিএসসি হতে দোয়েল চত্বর, বাংলামটর থেকে শাহবাগ মোড় হয়ে পল্টন মোড় এবং কাকরাইল থেকে মৎস্য ভবন মোড় হয়ে পল্টন পর্যন্ত যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি বাংলামোটর, কাকরাইল চার্চ, ইউবিএল, জিরো পয়েন্ট, গোলাপশাহ মাজার, চাঁনখারপুল, বকশীবাজার, পলাশী, নীলক্ষেত, কাঁটাবন ক্রসিং দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়মুখী সাধারণ গাড়িগুলোকে ডাইভারশান করে দেওয়া হয়। এসব এলাকার সড়ক দিয়ে চলাচলরত পরিবহনগুলো বিকল্প সড়ক ব্যবহার করায় দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, পল্টন থেকে বিজয়নগর হয়ে কাকরাইল, মালিবাগ থেকে রামপুরা, বাংলামটর থেকে মালিবাগ, কাকরাইল থেকে মগবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় যানজটের। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের।পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমাবেশ উপলক্ষে মিরপুর থেকে নেতাকর্মীবাহী যেসব বাসে এসেছেন সেগুলো মিরপুর রোড দিয়ে এসে নীলক্ষেত এলাকায় পার্ক করেছে। উত্তরা, মহাখালীর দিক থেকে যেসব গাড়ি এসেছে সেগুলো মগবাজার-কাকরাইল চার্চ-নাইটিঙ্গেল-ইউবিএল-জিরো পয়েন্ট-হাইকোর্ট হয়ে দোয়েল চত্বরে নামিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়ামে পার্ক করেছে।

ফার্মগেট-সোনারগাঁও-শাহবাগ হয়ে যেসব গাড়ি এসেছে সেগুলো টিএসসি রাইট টার্ন করে মল চত্বরে পার্ক করে। যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, বংশাল দিয়ে আসা গাড়িগুলো জিরো পয়েন্ট, হাইকোর্ট হয়ে দোয়েল চত্বরে নামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়ামে পার্ক করেছে। লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর থেকে আগতদের গাড়ি পলাশী-নীলক্ষেত এলাকায় পার্ক করে। পার্কিংয়ের কারণে এই সড়কগুলোতে যানচলাচল অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়।দুপুরের দিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কজুড়ে তীব্র যানজট। যানজটের কারণে অধিকাংশ সড়কে চালকরা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে আছেন। এর মধ্যেই দলীয় নেতাকর্মীরা মিছিলসহ সমাবেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

পান্থপথ সিগন্যালে আটকে থাকা দোলনচাঁপা বাসের চালক বাস থেকে নেমে ফুটপাতে বসে আছেন। বাসেও নেই কোনও যাত্রী। জানতে চাইলে চালক রায়হান বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। সে কারণে সব রাস্তায় তীব্র যানজট। এক ঘণ্টার উপরে এখানে বসে আছি। সিগন্যাল ছাড়ছে না। যাত্রীরাও সবাই নেমে গেছে।’

একই অবস্থা দেখা গেছে কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর ও ফকিরাপুল এলাকায়। এসব এলাকায় যানজটের কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। যানজটে আটকা পড়া যানবাহগুলোকে উল্টোপথে চলাচল করতেও দেখা গেছে।সড়কে যানজটের কারণে সেগুনবাগিচা থেকে পান্থপথের নিজ অফিসে হেঁটে এসেছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোরশেদ আলী। তিনি বলেন, সকাল ১১টার দিকে অফিসের কাজে সেগুনবাগিচায় গিয়েছিলাম। দুপুর ২টার দিকে কাজে সেরে আবার অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কিন্তু সেগুনবাগিচার সেগুন রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে রিকশা উঠে রাজস্ব ভবনের সামনে এসেই দেখি রাস্তায় তিল পরিমাণ ফাঁকা নেই। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হাঁটা শুরু করি।পুরো পথেই তীব্র যানজট দেখেছি।

এদিন সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যাও তুলনামূলক অনেক কম দেখা গেছে। বিকেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি হওয়ার পর গণপরিবহনের সংকট দেখা গেছে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ পরিবহন রিজার্ভ ভাড়া হয়ে যাওয়ায় এই সংকট দেখা গেছে বলে পরিবহন সংশ্লিষ্ট জানিয়েছেন।জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক বলেন, সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর অধিকাংশ গণপরিবহন রিজার্ভ ভাড়া হয়ে গেছে। যে কারণে এই পরিবহনগুলো সাধারণ যাত্রী তুলছে না।