বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর গাজীপুরস্থ প্রাইমারী গ্রাউন্ড স্টেশনের উদ্বোধন করা হচ্ছে মঙ্গলবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মঙ্গলবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স সেন্টার থেকে এর উদ্বোধন করবেন। একই সঙ্গে তিনি বেতবুনিয়ার ব্যাক-আপ গ্রাউন্ড স্টেশনটিও উদ্বোধন করবেন। এছাড়াও একইদিন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সফল উৎক্ষেপন উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে গাজীপুরের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টরা এদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গাজীপুরস্থ প্রাইমারী গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ওই ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হবেন।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর গাজীপুরস্থ প্রাইমারী গ্রাউন্ড স্টেশনের উদ্বোধন করা হচ্ছে মঙ্গলবার। এ উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তেলীপাড়ায় টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ সংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রাইমারি এ গ্রাউন্ড স্টেশন ক্যাম্পাস থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। গাজীপুরস্থ গ্রাউন্ড স্টেশন থেকেই তিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করবেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হবেন ও সরাসরি কথা বলবেন। একই সঙ্গে বেতবুনিয়ার ব্যাক-আপ গ্রাউন্ড স্টেশনটিও উদ্বোধন করা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগস্ট/সেপ্টেম্বর থেকেই বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।

প্রকল্পের পরিচালক মো. মেসবাহুজ্জামান এ প্রসঙ্গে জানান, মহাকাশে নির্বিঘেœ উৎক্ষেপণের পর স্যাটেলাইটটি এখন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সংকেত দিচ্ছে ও নিচ্ছে। স্যাটেলাইটটি থেকে কাঙ্খিত সেবা পেতে এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সার্বক্ষণিক ওই স্যাটেলাইটটির গতিবিধি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোন প্রকার সমস্যা দেখা দেয়নি। এখান থেকে ট্র্যাকিং ও কন্ট্রোলিংয়ের কাজ হচ্ছে। ফুল সিস্টেমটিকে টেস্টিং করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সকল টেস্ট ও ট্র্যাকিংয়ের কাজ সফলভাবে সমাপ্তির পর যে কোন সময় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কমার্শিয়াল অপারেশনে (বানিজ্যিক কার্যক্রম) যাবে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে।

তিনি আরো বলেন, এটা হলো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। এর গ্রাউন্ড স্টেশনে হিউজ সিস্টেম ইন্সস্টল করা হয়েছে। এখানে ভেতরে স্থাপিত আলাদা আলাদা ইকুইপমেন্ট ছাড়াও বাইরের পুরো সিস্টেমটিকে ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেস্ট করা হবে। বেতবুনিয়া এবং গাজীপুরে গ্রাউন্ড স্টেশনের ভেতরে ও বাইরে যত যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়েছে যেমন এন্টেনা, নেটওয়ার্কিং সিস্টেমসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট ছোট ছোট ভাগ করে টেস্টিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গ্রাউন্ড স্টেশন ও এন্টেনা টেস্ট করা শেষ হয়ে গেছে। এগুলো এখন পারফেক্টলি ফাংশনাল। এখন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বিভিন্ন প্রসেসে স্যাটেলাইট টেস্ট করা হচ্ছে।

তিনি জানান, উৎক্ষেপনের পর নির্দিষ্ট দূরত্বে দ্রাঘিমাংশে (প্রায় ৩৬হাজার কিলোমিটার দূরে ১১৯.১পূর্ব দ্রাঘিমাংশে) স্যাটেলাইটটি অবস্থান করছে। ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স-ইটালী থেকে স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণভাবে কন্ট্রোল করা হলেও বর্তমানে গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ট্র্যাকিং এবং কন্ট্রোলিং করা হচ্ছে। প্রকৌশলীরা এখান থেকে স্যাটেলাইটে সিগন্যাল পাঠিয়ে আবার তা রিসিভ করছে এবং এসব এনালাইসিস করছে। প্রয়োজন হলে সিগন্যাল পাঠিয়ে স্যাটেলাইটটিকে (১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পজিশনে) নির্দিষ্ট অবস্থনে ধরে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা করছে। এখান থেকে নিয়মিত ট্র্যাকিং ও কন্ট্রোলিং করা হচ্ছে। ট্র্যাকিংয়ের আন্ডারে অনেক এনালাইসিস আছে। কন্ট্রোলিংয়ের সঙ্গেও অনেক বিষয় আছে। স্যাটেলাইট সিগন্যাল যেটা পাঠায় ওটা আমরা রিসিভ করি। ওই সিগন্যাল দিয়ে আমরা তা চেক করি। পরে ওই সিগন্যালের উপর বেসিস করে আবার সিগনাল পাঠিয়ে স্যাটেলাইটটিকে কন্ট্রোল করা হয়। এখনও ফুল সিস্টেমটিকে টেস্ট করা হচ্ছে, আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে ওটা ফাংশনাল কিনা তা দেখা হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। এভাবে ফুল টেস্ট শেষ করতে হয়ত সেপ্টম্বর লেগে যাবে, তারপর আমরা কমার্শিয়াল অপারেশনে যাব।

প্রকল্পের পরিচালক মো. মেসবাহুজ্জামান আরো জানান, গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটে নির্দিষ্ট পাওয়ারের একটা সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছে, সেই সিগন্যালটি সেই পাওয়ারে আবার ফেরত আসছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এরজন্য টেস্ট ইকুপমেন্ট, ফ্রিকুয়েন্সি এনালাইজার, স্পেক্ট্রাম এনালাইজারসহ বিভিন্ন জটিল জটিল ইকুপমেন্ট দিয়ে এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে এ পরীক্ষা করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কোন পার্থক্য পাওয়া যায়নি। যে পরিমান সিগন্যাল পাঠানো হয়েছে সেই পরিমান সিগন্যালই ফেরত পাওয়া গেছে। বর্তমানে গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনে বাংলাদেশী ৩০জন ও ১০জনের মত ফ্রান্সের প্রকৌশলী সার্বক্ষণিক কাজ করছে।

তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে পৃথক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কো¤পানি। যার নাম হলো- বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)। এ উপগ্রহের পরিষেবা নিতে ইতোমধ্যে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিসিএসসিএল’র ৮জুলাই চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়া এর সেবা নিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে বিসিএসসিএল। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে তারা প্রস্তাবও পেয়েছে।

কনসালট্যান্ট এসএম নুসরাত দস্তগীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে ১২ মে বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিটে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি হলো কমিউনিকেশন সাটেলাইট। টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবেশ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ই-সেবা নিশ্চিত করবে।

এছাড়া আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-রিসার্চ, ভিডিও কনফারেন্স প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। এটির অবস্থান প্রায় ৩৬হাজার কিলোমিটার উপরে।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাবে
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ যোগাযোগ এবং সম্প্রচার কাজেই মূলত ব্যবহার করা হবে। এ স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার প্রায় ৩৬ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গের সমপরিমাণ। অর্থাৎ, ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থেকে পাওয়া যাবে প্রায় এক হাজার ৪৪০ মেগাহার্টজ পরিমাণ বেতার তরঙ্গ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। আর ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে।

৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি হচ্ছে কেইউ ব্যান্ডের এবং ১৪টি সি ব্যান্ডের। গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় স্থাপিত দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এর মধ্যে গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশনটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে এবং বেতবুনিয়ার স্টেশনটি ব্যাক আপ অর্থাৎ বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এরই মধ্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেছে দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিবছর অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে এ অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। ফলে বড় অঙ্কের টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর স্যাটেলাইট ভাড়াবাবদ ব্যয়ও কমে আসবে। এ ছাড়া স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ। ফলে ব্যান্ডউইথের বিকল্প উৎসও পাওয়া যাবে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও উদ্ধারকর্মীরা স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ রেখে দুর্গত এলাকায় কাজ করতে সক্ষম হবেন। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও এশিয়ার অন্য অংশে কিরগিজস্থান, তাজিকিস্তানের মতো দেশেও ভাড়া দেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা (প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) আয় করতে সমর্থ হবে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, গত ১২ মে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিটে ) যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করা হয়। এ স্যাটেলাইটটি মহাকাশে ডানা মেলার মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে।