বছর ঘুরে আবার এসেছে বাংলাদেশের শোকের দিন ১৫ অগাস্ট; গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতি পালন করছে জাতির জনককে হারানোর দিনটি।১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে।তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি।জাতীয় এই শোকের দিনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে, পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি।

বিন¤্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর গভীর শোকাবহ পরিবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেছে জাতি। বুধবার (১৫ আগস্ট) দিবসের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে লাখো মানুষের ঢল নামে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। সকাল সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এর পর দলের সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং মন্ত্রীসভার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। ফুল দিয়ে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সশস্ত্র সালাম জানায়; বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।এরপর কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ১৫ অগাস্ট নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানানোর পর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ৩২ নম্বর চত্বর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়৷ এরপর রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানে শুরু হয়৷ বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ভিড়ে রাসেল স্কয়ার থেকে কলাবাগান পর্যন্ত রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়৷ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে জীবন দেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকরা রাতের অন্ধকারে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশের বাইরে থাকায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

এদিকে, দেশব্যাপী সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর ৪৩তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে পালিত হচ্ছে। ভোরে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিসবটি উপলক্ষে আগের দিন মঙ্গলবার রাত থেকেই রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাজানো হয়। আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে পাড়া-মহল্লায় সুস্থদের মধ্যে খাবার বিরতণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভোর থেকেই বুকে কালো ব্যাচ ধারণ করে মানুষ ছুটতে থাকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। সকাল ৭টার আগেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাসেল স্কয়ার থেকে কালাবাগান, সোবহানবাগ, স্কয়ার হাসপাতালসহ পুরো এলাকায় লাখো জনতার ঢল নামে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফুল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এগিয়ে যায় ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনের চত্বরের দিকে। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে পুরো এলাকা।আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের দিকে মানুষ ছুটতে থাকে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যান বনানী কবরস্থানে। সেখানে তিনি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার তার পরিবারের সদস্যদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও বনানীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সেখানেও জনতার ঢল নামে।সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেন। এদিকে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, কোরানখানি, দোয়া মাহফিল, রক্তদান কর্মসূচিসহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

৪৩ বছর আগে সেই রাতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ছাড়াও স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে। সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকট আত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।ধানমন্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।বঙ্গবন্ধুকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।দিনটি উপলক্ষে দেশের সব ধর্মীয় উপসনালয়ে হয় বিশেষ প্রার্থনা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দুপুরে বঙ্গভবনের দোয়া মাহফিলে রাষ্ট্রপতি উপস্থিত ছিলেন ।

রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করছে এ দিনে। শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, পোস্টার বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠান।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি।এরপর বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ছেষট্টির ছয় দফা প্রণয়নে ভূমিকা রেখে এবং ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।

১৯৬৯ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দেন তিনি।তার নেতৃত্বে রক্তাক্ত সংগ্রামেই অভ্যূদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। আর স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের।১৯৭৫-এর পর ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পালিত হয়ে আসছে ১৫ অগাস্ট। ’৭৫ এর পর ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালিত হয়নি।আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ১৫ অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে জাতীয় শোক দিবস বাতিল করে দেয়।পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হাই কোর্টের রায়ে ২০০৮ সাল থেকে দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাসের নৃশংসতম এই রাজনৈতিক হত্যাকা-ের আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচার শুরু হয়। তবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায়।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার বিচার চূড়ান্তভাবে শেষ করার পর ২০১০ সালে পাঁচ খুনির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তবে দন্ডিত ছয় খুনি এখনও বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন।