“লাব্বয়িক আল্লাহ হুম্মা লাব্বায়ীক লাব্বায়িকা লা শারিকালাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওউয়াল মুলকা লা শারিকালা”  আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য এমন কিছু দিন বা স্থানকে বিশেষভাবে ফযিলতপূর্ণ করেছেন যাতে বান্দারা নিজেদেরকে গুনাহমুক্ত করে পাক-পবিত্র করে নিতে পারে। এ রকম একটি দিন হলো যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ইয়াউমে আরাফা বা আরাফার দিন। এ দিনটিকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে হাদীস শরীফে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যে দিনে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত হাজী সাহেবানরা এমন একটি স্থানে অবস্থান করেন যার নাম আরাফার ময়দান। আর আরাফার ময়দানে অবস্থান করাটা হজ্জ পালনকারীদের জন্য অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। আরাফার ময়দান ক্ষমা পাওয়ার ময়দান হিসেবেও পরিচিত। এ দিনে হাজীরা মিনা থেকে আরাফার ময়দানে সমবেত হন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এটিই হজ্জের প্রধান রুকন। হাদিসে এরশাদ হয়েছে, ‘আরাফাতে অবস্থান করাই হজ্জ। অর্থাৎ হজ্জের সবচেয়ে বড় রুকন। ফজিলত হিসেবে এ দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর ইবাদতের জন্য যিলহজ্বের প্রথম দশ দিনের চেয়ে উত্তম কোন দিন নেই, এর একদিনের রোযা এক বছরের রোযার সমতুল্য এবং এক রাতের ইবাদত ক্বদরের রাত্রের ইবাদতের সমতুল্য। (তিরমিযী-৭৫৮, ইবনে মাজা-১৭২৮)

অন্য বর্ণনায় হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে: যিলহজ্বের দশ দিনের চেয়ে কোনো দিনই আল্লাহর নিকট উত্তম নয়। (সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ২৮৪২)

আরাফা দিবসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফযিলত ও আমল

আরাফার দিনটি মূলত হজ্জের মূল দিন ঃ
ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো হজ্জ। আর আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হজ্জ। এদিনের গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে সহীহ হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“আরাফাতে অবস্থান করাই হলো হজ্জ।” [সুনান নাসাঈ: ৩০৪৪, তিরমিযী, ৮৮৯, আবু দাউদ-১৯৪৯, ইবনু মাযা-৩০১৫]
এ দিন হল ঈদের দিন সমূহের একটি দিন ঃ
আরাফার দিনটি ইসলামে এতো মর্যাদাপূর্ণ যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাকে ঈদের দিন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। উকবাহ বিন আমের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“আরাফাতের দিন, কুরবানীর দিন এবং তাশরীকের দিনসমূহ (কুরবানী পরবর্তী তিন দিন) হচ্ছে ইসলামে আমাদের ঈদের দিন। এদিনগুলো হচ্ছে পানাহারের দিন।” [সুনান আবু দাউদ: ২৪২১]
আরাফার দিনে আল্লাহতায়ালা তাঁর নিয়ামত ও দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছেন ঃ মহান আল্লাহ এরশাদ করেন:
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ : ‏( ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲ ﻭَﺭَﺿِﻴﺖُ ﻟَﻜُﻢُ ﺍﻟْﺈِﺳْﻠَﺎﻡَ ﺩِﻳﻨًﺎ ‏) ﺍﻟﻤﺎﺋﺪﺓ /৩ .
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [মায়েদা-০৩]
সহীহ বুখারীতে এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে:
ﻋَﻦْ ﻃَﺎﺭِﻕِ ﺑْﻦِ ﺷِﻬَﺎﺏٍ ، ﻗَﺎﻝَ : ﺟَﺎﺀَ ﺭَﺟُﻞٌ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻴَﻬُﻮﺩِ ﺇِﻟَﻰ ﻋُﻤَﺮَ ، ﻓَﻘَﺎﻝَ : ﻳَﺎ ﺃَﻣِﻴﺮَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﺁﻳَﺔٌ ﻓِﻲ ﻛِﺘَﺎﺑِﻜُﻢْ ﺗَﻘْﺮَﺀُﻭﻧَﻬَﺎ ، ﻟَﻮْ ﻛَﺎﻥَ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻣَﻌْﺸَﺮَ ﺍﻟْﻴَﻬُﻮﺩِ ﻧَﺰَﻟَﺖْ ﻻﺗَّﺨَﺬْﻧَﺎ ﺫَﻟِﻚَ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻋِﻴﺪًﺍ . ﻗَﺎﻝَ : ” ﻭَﺃَﻳَّﺔُ ﺁﻳَﺔٍ ؟ ” ﻗَﺎﻝَ : ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲ ﻭَﺭَﺿِﻴﺖُ ﻟَﻜُﻢُ ﺍﻹِﺳْﻼﻡَ ﺩِﻳﻨًﺎ ﺳﻮﺭﺓ ﺍﻟﻤﺎﺋﺪﺓ ﺁﻳﺔ ৩ . ﻓَﻘَﺎﻝَ ﻋُﻤَﺮُ : ” ﺇِﻧِّﻲ ﻷَﻋْﻠَﻢُ ﺍﻟْﻤَﻜَﺎﻥَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻧَﺰَﻟَﺖْ ﻓِﻴﻪِ ، ﻭَﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺃُﻧْﺰِﻟَﺖْ ، ﻧَﺰَﻟَﺖْ ﻋَﻠَﻰ ﺭَﺳُﻮﻝِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺑِﻌَﺮَﻓَﺎﺕٍ ﻳَﻮْﻡَ ﺟُﻤُﻌَﺔٍ ‏) ﺻﺤﻴﺢ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻹﻳﻤﺎﻥ , ৪৫
ইহুদীরা হযরত ওমর রাদিআল্লাহু আনহুকে বললো, তোমরা কুরআনের এমন একটা আয়াত তেলাওয়াত করো যদি সে আয়াতটা আমাদের মাঝে নাযিল হতো তাহলে আমরা সেদিনকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করতাম। হযরত ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, নিশ্চয়ই আমি জানি সে আয়াত কোনটি এবং তা কখন, কোথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে। সেদিন হচ্ছে আরাফাতের দিন, সে দিনটি ছিল জুম‘আর দিন। আল্লাহর শপথ আমরা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আরাফাতেই ছিলাম।(বুখারী হা/৪৫, ৪৬০৬) সে আয়াত হচ্ছে: আজ আমি তোমাদের জন্য আমার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।’’ [সূরা আল মায়িদাহ: ০৩]

হযরত ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনে আববাস রাদিআল্লাহু আনহুমা বলেন, সূরা মায়েদার এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে দু’টো ঈদের দিনে। তা হ’ল জুম‘আর দিন ও আরাফাহর দিন।[ছহীহ জামি‘ তিরমিযী, হা/২৪৩৮]
আরাফাহ দিবসের ছিয়াম (রোযা) দু’বছরের গোনাহের কাফফারা ঃ
আরাফার দিনটি এত ফযিলতপূর্ণ যে, এই দিনের সিয়াম পালনকারীর দুই বছরের গুনাহ মাফ করা হয়। আবু কাতাদা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, আরাফাতের দিবসের সিয়াম পালনের ফযিলত কী: উত্তরে তিনি বলেন:
‘‘যে ব্যক্তি আরাফার দিনে (একটি) সিয়াম পালন করলো, আল্লাহতায়ালা তার পেছনের এক বছরের ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’’ [সহীহ মুসলিম: ২৮০৩]
তবে এই দিনে হাজী সাহেবরা সিয়াম পালন করবেন না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজীদেরকে এই
দিনে সিয়াম পালন করতে নিষেধ করেছেন।
আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন ঃ
এদিন হচ্ছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিন। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন ঃ
“আরাফাতের দিনে এত অধিক সংখ্যক বান্দাকে আল্লাহতায়ালা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন, যা অন্য কোন দিন দেয়া হয় না। সেদিন তিনি বান্দার অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়ে যান (এখানে নিকটবর্তী হয়ে যাওয়া মানে হলো, আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদের দিকে বিশেষ কৃপা ও দয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন) এবং ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন,তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দারা আমার কাছে কি চায়?” [মুসলিম হা/১৩৪৮]

আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,“যখন আরাফার দিন হয়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন (এখানে নেমে আসা মানেও হল, বান্দাদের দিকে বিশেষ কৃপা ও দয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন), অতঃপর তিনি আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, আমার এ সকল বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ। তারা এলোমেলো কেশ ও ধূলায় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে।” [আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/৮১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৬৬১; মিশকাত হা/২৬০১]

আরাফার দিন হলো দোয়া করার উত্তম দিন ঃ
আমর বিন শুয়াইব তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সর্বোত্তম দোয়া হচ্ছে আরাফাতের দিনের দোয়া। আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ এদিনে উত্তম যে দোয়াটি পড়তাম তা হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইইন ক্বাদীর।’’ [সুনান আত তিরমিযী: ৩৫৮৫, হাসান।

আরাফার দিনসহ যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন বেশি বেশি যিকির করার বিষয়ে হাদীসে বিশেষ তাকিদ দেয়া হয়েছে ঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবন ওমার রাদিআল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের অধিক মর্যাদাবান আর কোন দিন নেই এবং নেক আমল করার জন্য এ দিনগুলোর চেয়ে বেশি প্রিয় দিন আর নেই। অতএব তোমরা এদিনগুলোতে বেশি বেশি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদু লিল্লাহ’’ পাঠ কর।’’ [মুসনাদ আহমাদ: ৬১৫৪]

এদিনকে কুরআন মাজীদে বিতর বা বেজোড় দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ঃ
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আল ফাজরে এ দিনের কসম করেছেন। এ বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবন আববাস রাদিআল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘‘জোড় দ্বারা কুরবানীর দিন, বেজোড় দ্বারা আরাফার দিবসকে বুঝানো হয়েছে।’’ [ফাতহুল ক্বাদীর-শাওকানী, খ-৭ পৃষ্ঠা: ৪৮৯]
এদিনটি যিলহজ্জের মাহিমান্বিত দশ দিবসের মধ্যে অন্যতম ঃ
এ দিনে নেক আমলের বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম বলেছেন, হযরত ইবন আববাস রাদিআল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“এ দিনগুলোর নেক আমলের চেয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে বেশি প্রিয় কোন আমল নেই, অর্থাৎ যিলহজ্জের দশ দিবসের নেক আমল” সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহও কি নয়? তিনি বলেন, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহও এ দিনগুলোর নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়, কেবল সে ব্যক্তির আমল ব্যতীত, যে স্বীয় জীবন ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে আর কিছু নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেনি।” [সুনান আবু দাউদ: ২৪০০]

মোঃ খালেদ বিন ফিরোজ