রাজধানীর পশুর হাটে দাম ছাড়ছে না ব্যাপারীরা। পশুর আকারের তুলনায় দাম অনেক বেশি চাচ্ছেন তারা।ক্রেতাদের অভিযোগ, গত বছর যে গরু ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে এবার সে গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৮০ হাজার। এক লাখের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে দেড় লাখ টাকা। ফলে ক্রেতারা বাজার ঘুরেও গরু কিনতে পারছেন না।তবে ব্যাপারীরা বলছেন, খরচ বেশি। খাদ্য, ওষুধ, পরিবহন ও রাস্তার খরচ মিলে পশুর দাম বেশি পড়েছে।শনিবার (১৮ আগস্ট) রাজধানীর কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, এখনও গরু আসছে। তবে বিক্রি তেমন শুরু হয়নি। সিটি কর্পোরেশনের ঘোষণা অনুযায়ী মূল হাট শুরু হবে রোববার (১৯ আগস্ট) থেকে। ক্রেতারা এখন হাটে আসছেন, ঘুরছেন, পশু দেখছেন এবং দরদাম করছেন। কিন্তু ব্যাপারিদের দামের সঙ্গে পেরে উঠছেন না।
ঢাকায় নির্ধারিত সময়ের আগেই হাটে কোরবানির পশু তোলা হয়েছে। দুই সিটি কর্পোরেশনের ইজারার শর্তে বলা আছে, আগামী ১৯ আগস্টের আগে হাটে পশু বেচাকেনা করা যাবে না। হাট প্রস্তুতও করা যাবে না ১৮ আগস্টের আগে। কিন্তু এ শর্ত না মেনে আগে থেকেই হাট শুরু করেছেন ইজারাদাররা। অধিকাংশ হাটে ইতোমধ্যে কোরবানির পশু উঠেছে, চলছে দরদামও।সিটি কর্পোরেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে ইজারাদাররা শর্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।শুক্রবার হাজারীবাগ, শনির আখড়া, অফতাবনগরসহ অন্যান্য হাট ঘুরে দেখা গেছে, সব হাটেই পশু উঠেছে কদিন আগে থেকেই।
হাটের ইজারাদাররা বলছেন, সিটি কর্পোরেশন যে সময় দিয়েছে, তাতে হাট প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। যে কারণে একটু আগেই প্রস্তুতি শুরু করতে হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পশু আগেভাগেই বিক্রেতারা আনেন। আমরা চেষ্টা করছি, জনসাধারণের যেন কোনো সমস্যা না হয়।শনির আখড়ায় হাটের ইজারাদার মোস্তাক আহমেদ বলেন, আমাদের ভলান্টিয়াররা এখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। যানজট-মানুষের ভোগান্তি যেন না হয় সে বিষয়ে আমরা সজাগ আছি। আগে হাট বসার কারণে আশা করছি, মানুষের ভোগান্তির কিছু হবে না।এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, কোনো ইজারাদার যদি শর্ত ভঙ্গ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।দুই সিটির সূত্রে জানা গেছে, এবার কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে ২৩টি স্থানে অস্থায়ী হাট বসানোর জন্য প্রথমে দরপত্র আহ্বান করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। তিন দফায় বিজ্ঞপ্তির পরও আট হাটের বিপরীতে কোনো দরপত্র জমা পড়েনি অথবা কাক্সিক্ষত দর পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে দক্ষিণের ছয়টি আর উত্তরে দুটি হাট ছিল।এখন ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া এই হাটগুলোর স্পট টেন্ডারের মাধ্যমে টোল আদায়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আরও দু-একটি হাট বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে উত্তর সিটির দুটি হাট এখন লিজ দেয়া হয়েছে।
মোহাম্মদপুর বসিলা পুলিশ লাইন গরুর হাটে কোরবানির গরু কিনতে এসেছেন আকবর হোসেন। তিনি জানান, দুই-তিন ঘণ্টা হাটে ঘুরেছি। গরুর দাম অনেক বেশি চাচ্ছে।রাজধানীর শঙ্কর থেকে বসিলার এ বাজারে এসে ৮০ হাজার টাকায় গরু কিনেছেন আবদুর রউফ। তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবার গরুর দাম বেশি। এরপরও টেনশন মুক্ত থাকতে আগেই কিনলাম।বসিলা পুলিশ লাইন হাটে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রচুর গরু আমদানি হয়েছে। তবে বিক্রি খুব কম। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে গরু এনেছেন মো. আবদুর রহিম। পাঁচটি গরু নিয়ে আসা আবদুর রহিম বলেন, তিনদিন হলো হাটে এসেছি। একটি গরু আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। এখনো চারটি গরু আছে। গরু পালতে যা কিছু দরকার তার সব কিছুরই দাম বেশি। তাহলে আমারা কম দামে কিভাবে গরু বিক্রি করব?রাজধানীর হাজারীবাগ পশুর হাটে ১৫টি গরু এনেছেন ঝিনাইদহের আজিজুল ইসলাম। তার সব গরু মাঝারি আকারের। প্রতিটি গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে লাখের উপরে।আজিজুল বলেন, এক মাস আগে গ্রামের হাট থেকে গরুগুলো কেনা হয়েছে। ঢাকায় নিয়ে আসা ও গরুর খাওয়া, আমাদের খাওয়া থাকাসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি গরুর পিছনে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ পড়েছে। ফলে কেনা দামের সঙ্গে আরও পাঁচ হাজার টাকা যুক্ত করলে এবং লাভ করতে হলে দামতো বেশি হবেই।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাট কমিটি খুব ভালো। আমাদের থাকা খাওয়া ও গোসলের ব্যবস্থা করেছে।বসিলা পুলিশ লাইন হাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইসরাফিল হোসেন বলেন, ব্যাপারি, খামারি ও কৃষক যারাই এ হাটে গরু আনবে তাদের জন্য সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে। নিরাপত্তার জন্য সব সময় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ বক্সে জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন আছে।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাপারিরা কত টাকায় পশু বিক্রি করবে আর ক্রেতা কত টাকা দিয়ে কিনবে তা তারাই বুঝবে। এ ব্যাপারে হাট কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। বিক্রেতারা দাম বেশি চাইলে ক্রেতা দরদাম করে কিনবে।রাজধানীর হাজারীবাগ পশুর হাটে মাঝারি ও ছোট আকারের গরু বেশি আনা হয়েছে। ব্যাপারীরা বললেন, বড় গরুর গ্রাহক কম। তাছাড়া বড় গরুর ঝুঁকি বেশি। দূর-দূরান্ত থেকে বড় গরু আনতে খুব অসুবিধা। ট্রাকের মধ্যে পড়ে গিয়ে পা ভাঙার সম্ভাবনা থাকে। ফলে বড় গরুর চেয়ে ছোট গরুতে ঝুঁকি কম, লাভ তুলনামূলক বেশি।প্রায় আড়াই কিলোমিটার আয়তনের এ হাট ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেল, ছোট ও মাঝারি আকারের গরু বেশি। যে ট্রাকগুলো থেকে গরু নামানো হচ্ছিল সেগুলোও মাঝারি মানের।নাটোর গুরুদাসপুর থেকে এসেছেন গরুর ব্যাপারী বরকত। তিনি এবার ২০টি গরু এনেছেন এই হাটে। আশা করছেন ২০টি গরু বিক্রি করে দুই লাখ টাকা লাভ করবেন। গত বছর ১৫টি গরু এনেছিলেন এই বাজারে। যদিও সেবার গরু বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিল তার।শুধু গরু উঠেছে এ হাটে। ছাগল, মহিষ, ভেড়া শুক্রবার সকাল পর্যন্ত উঠেনি। তবে ইজারাদাররা বলছেন, আগামী দুদিনের মধ্যে এই হাট ভরে যাবে পশু দিয়ে। ছাগল, ভেড়া সবই আসবে। গত বছর প্রায় ৫০ হাজার পশু বেচাকেনা হয় এ হাটে। এবার আরও বেশি হবে বলে তারা আশা করছেন।হাজারীবাগ হাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মুসা হাসান বলেন, এই পশুর হাটের পরিধি লেদার কলেজ এলাকা থেকে শুরু করে হাজারীবাগ বাজারের সব রাস্তা, কালু নগরের সব রাস্তা এবং বেড়ী বাঁধের মুখ পর্যন্ত। সব মিলে হাটের আয়তন প্রায় আড়াই কিলোমিটার। আগামী দুদিনের মধ্যে পুরো হাটে পশু দেখতে পাবেন।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাজারীবাগ হাটে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চাহিদা বেশি। এ কারণে এই হাটে মাঝারি ও ছোট গরু বেশি আনা হয়েছে।এ হাটের ইজারাদারের ছোট ভাই মো. জুবায়ের হোসেন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হাজারীবাগ হাটে ব্যাপারীদের থাকা-খাওয়া, পানি, গোসল, গরুর খাবারসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অসংখ্য সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। জালটাকা শনাক্তে মেশিন বসানো হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিজেদের উদ্যোগে চিকিৎসক নিয়ে আসা হয়েছে। গরুর প্রাথমিক চিকিৎসার টাকা হাট কর্তৃপক্ষ বহন করছে। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে পশুর চিকিৎসক থাকার কথা থাকলে এখন পর্যন্ত তারা আসেনিন। রাজধানীর ঢাকার অন্যতম গাবতলী হাটে কোরবানির গরু আসা শুরু করেছে। তবে গরু থাকলেও বেচাকেনা সেভাবে জমে ওঠেনি। ক্রেতারা হাটে হাটে ঘুরে গরু দেখে যাচ্ছেন। দাম যাচাই করছেন, কিনছেন না। এদিকে গরুর দাম কমাচ্ছেন না ব্যাপারীরা।
শনিবার গাবতলীর পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, কোরবানি উপলক্ষে স্থায়ী এই হাট নির্দিষ্ট জায়গা ছাপিয়ে আশপাশে বিস্তৃত হয়েছে। বেশ অনেকখানি জায়গাজুড়ে রাখা হয়েছে কোরবানির পশু। বেড়িবাঁধের পাশেও কিছু কিছু গরু দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে দেশি গরুর পরিমাণ বেশি। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী থেকে গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারীরা। এর মধ্যে কুষ্টিয়া থেকে আনা গরুর সংখ্যাই বেশি। ব্যাপারীরা সবাই নিজেকে খামারি বলে দাবি করেছেন।
এমন একজন ফজলু ব্যাপারী ২৯টি গরু নিয়ে এসেছেন হাটে। গতকাল রাতে গরুগুলো নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে রওনা হয়ে আজ সকালে গাবতলী পৌঁছেছেন। তিনি জানান, গরু আনার সময় পথে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। কোনো বাধারও শিকার হননি।ঝিনাইদহের ব্যাপারী আবদুর রহমান মাঝারি আকারের এক গরুর দাম এক লাখ টাকা চেয়েছেন। কয়েকজন ক্রেতা গরুটিকে দেখে গেছেন। দামে বনিবনা হয়নি বলে ক্রেতারা কেনেননি। একজন ক্রেতা বললেন, তাঁর কাছে গরুটির দাম ৭০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে মনে হয়েছে।এদিকে আবদুর রহমান বললেন, এক লাখ টাকার কমে তিনি গরুটি বিক্রি করবেন না। তিনি এই দামেই বিক্রি করার জন্য অপেক্ষা করবেন। যদি এই দাম না পান, তাহলে বিক্রি না করে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। মো. আতোয়ার নামের একজন ক্রেতা বলেন, এই গরু গত বছর ঈদুল আজহায় ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক বছরে দাম বড়জোর ১০ হাজার টাকা বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, ৭০ হাজার টাকা হলেও মেনে নেওয়া যেত। এক লাখ টাকা অতিরিক্ত দাম এই গরুর জন্য। এত দাম কেন চাইছে, অবাক লাগছে।
তবে ব্যাপারীদের গৎবাঁধা অজুহাত, খড়সহ গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরুর দাম বেশি।মো. মোস্তফা নামের এক ক্রেতার দেখা পাওয়া যায় গাবতলীতে। তিনি ব্যবসায়ী। দুটো গরু কোরবানি দেবেন এবার। তিনি জানালেন, গতকাল শুক্রবার বাড্ডার নতুন বাজার হাটে গিয়েছিলেন। সেখানে গরু মোটামুটি আছে। কিন্তু দাম বেশি। বিক্রেতারা দাম ছাড়ছেন না। পরে তিনি মিরপুরে ইস্টার্ন হাউজিং গরুর হাটে গিয়েছিলেন। গাবতলী এসেছেন। বিক্রেতার সঙ্গে এখনো দরদামে বনিবনা হয়নি। তিনি জানান, এবার তাঁর দেড় লাখ টাকা বাজেট। এই টাকার মধ্যে দুটো গরু কিনবেন। আজ কিনতে না পারলে কাল আবার হাটে আসবেন। হাতে সময় আছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখবেন। তা না হলে ঈদের দিন সকালে এসে গরু কিনে নেবেন।গাবতলী পশুর হাটে সানোয়ার হোসেন নামের একজন ব্যবস্থাপক বলেন, হাটে স্থায়ী হাসিলঘর আছে একটি। কোরবানি উপলক্ষে নয়টি অস্থায়ী হাসিলঘর তৈরি করা হয়েছে। হাসিলঘরে বেচাকেনার পরিমাণ খুব কম। বিক্রি হচ্ছে না বললেই চলে। ক্রেতারা শুধু গরু দেখে যাচ্ছেন। তিনি জানান, প্রতিদিন প্রচুর গরু আসছে হাটে। কাল থেকে বিক্রি বাড়ার আশা করছেন।