নাব্যতা সংকট আর ডুবোচরে নৌপথ সরু হয়ে আসছে দেশের অন্যতম শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুট। ফলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে ঘাট এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। যাত্রীবাহি পরিবহন ও হালকা যানবাহন অগ্রাধিকার দিয়ে পার করায় বিপাকে পড়েছে ট্রাক চালকরা। এই সুযোগে সিরিয়াল বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা করছে ঘাটের এক শ্রেণীর অসাধু চক্র। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। এতে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছে পারাপারের অপেক্ষায় থাকা পরিবহন চালক, শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রীরা।

রবিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাঁঠালবাড়ি ফেরি ঘাটের বিআইডব্লিউটিএ’র কাউন্টারের সামনে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি টিম যাত্রীবাহি পরিবহন, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ অন্য ছোট-বড় যানবাহন থেকে নির্ধারিত টিকিট ও কুপন ছাড়াই টাকা নিচ্ছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এদের মধ্যে কে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের সাথে যোগ দিয়ে টাকা নিচ্ছে আনছার বাহিনীর পোষাক পরিহিত কয়েকজন সদস্য।এদের মধ্যে আবার ভিন্ন পোষাকেরও কয়েকজন সাথে ট্রাক আসলেই সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে টাকা নিয়ে আসছে। এভাবে এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে প্রায় শতাধিক ছোট-বড় পরিবহন থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছে চক্রটি। এরইমধ্যে সাংবাদিক দেখে কয়েকজন যুবক তেড়ে আসে, বাঁধা দেয় ক্যামেরায় ছবি তুলতে। তিন-চার জন কেটেও পড়ে।সরেজমিন অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কাঁঠালবাড়ি ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক ট্রাক চালক ও শ্রমিকরা। গত দশ দিন ধরে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে উজানে ব্যাপক নদী ভাঙ্গনের ফলে তীব্র ¯্রােতের সাথে ভেসে আসা পলির কারণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে পাঁচ দিন ধরে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। ফলে এই রুটের ডাম্ব, রো-রো ও কে-টাইপ ফেরি বন্ধ করে দেয় বিআরডব্লিউটিসি। কোন রকম টাল-মাটামের মতো ছোট ৮টি ফেরি চলাচল করছে। এতে ঘাট এলাকায় দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। এই পরিস্থিতিতে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ যাত্রীবাহী বাস ও হালকা পরিবহন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপার শুরু করে। তবে দুর্ভোগে পড়ে ভারি মালামালবাহি ট্রাক। এই সুযোগেই সিরিয়ালের নামে রমরমা বাণিজ্য শুরু করে হাইওয়ে পুলিশ, স্থানীয় সাধারণ পুলিশ, ঘাট ইজারাদার, বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঘাট এলাকার এক শ্রেণীর অসাধু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এতে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ে ঘাটে আটকে পড়া ট্রাক চালক ও শ্রমিকরা। এর জন্যে অনেক ট্রাক চালক দায়ী করেন, ড্রেজিং গাফলতি আর প্রশাসনের নজরদারীকে।

টাকা উত্তোলনের সাথে থাকা বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারি পরিচয় দেয়া সবুর হোসেন নামের একজন জানান, ‘আমরা বিআইডব্লিউটিএ, আনছার বাহিনী, ঘাট ইজারাদারের লোকজন মিলে এক সাথে টাকা নেই। নির্ধারিত কুপনের বাহিরে টাকা নেয়া হয় না। তবে অন্যরা কিছু নিতে পারে। সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা সরকারী লোক, তবে আমাদের মাঝে মাঝে স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করে। বাড়তি কোন টাকা নেয়ার সুযোগ নেই।’ তার সাথে সাথে অন্যরা একই কথা বলেন।তবে ঝালকাঠি থেকে আসা পশুবাহী ট্রাকের চালক আব্দুস মোবারেক জানান, আমি ভাঙ্গা থেকে এই পর্যন্ত পাঁচ জায়গায় টাকা দিয়ে এসেছি। সিরিয়াল করতে যেখানে আগে ৫’শ থেকে ৭’শ টাকা দিতে হতো, এখন সেখানে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। টাকা না দিলে সিরিয়াল মিলছে না। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে এই চক্রের লোকজন রাখা আছে। পুলিশকে বললেও কাজ হচ্ছে না। তাদেরও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। ফেরি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বললেও কাজ হচ্ছে না। তাদের যোগসাজসে স্থানীয় প্রভাবশারীরা টাকা তুলে।দশ দিন ধরে পারাপারের অপেক্ষায় থাকা ট্রাক চালক রমিজ উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি টাকা দিতে পারি নাই বিধায় দশ দিন ধরে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে বসে। কোন দিন পার হতে পারবো, সেটাও জানি না। ঘাটের লোকজনকে কিছু বললে ছোট ছোট ছেলেরাও মারধর করে। যে টাকা ভাড়া নিয়ে আসছিলাম, সেই টাকাও এখন শেষ পর্যায়ে, কিভাবে বাড়ী যাবো সেটা নিয়েও টেনশনে আছি।

অতিরিক্ত টাকা উত্তোলনের বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র কাঁঠালবাড়ি ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক অব্দুল মোমিন বলেন, আমরা নির্ধারিত টিকিটের বাহির এক পয়সাও নিচ্ছি না। আমাদের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী অতিরিক্ত টাকা নেয়ার সাথে জড়িত না। ফেরির বাহিরে সিরিয়ালের নামে কেউ টাকা নিতে পারে। সেটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কে কি করলো, সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হালকা পরিবহান ও পশুবাহী ট্রাক পারাপার করছি। আপাতত ৮টি ছোট ফেরি দিয়ে পরিবহন পারাপার করা হচ্ছে। নৌরুটের নাব্যতা সংকট সমাধান না হলে আমাদের কিছুই করার নেই। আর কাঁঠালবাড়ি ঘাটের দায়িত্ব থাকা ট্রাফিক ইন্সপেক্টর উত্তম শর্মা টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, ‘যারা সাংবাদিকদের কাছে টাকা নেয়ার বিষয়টি অভিযোগ করেন, তারা মূলক সঠিকভাবে পার না হতে পেরে বলে। যদি পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠে, তাহলে দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি দেখা হবে। আমাদের কোন সদস্য টাকা নেয়ার সাথে জড়িত নয়।’ তিনিও দ্রুত ড্রেজিংয়ের পর্রামশ দেন।কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে যাত্রী ও পশুবাহী যান পারাপার নিয়ে সংশয় বাড়ছে সাধারণ যাত্রীদের মাঝেও। বর্তমানে এরুটে ৮টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও ২ শতাধিক স্পীডবোট চলাচল জন্যে রয়েছে। ঈদের চাপ বাড়ায় অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছে যাত্রীরা। এবিষয়য়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ জেলার যাতায়াতকারী যাত্রীরা।