কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে চলতি বছরের মার্চে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস বাংলার পাইলট আবিদ সুলতান মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে কাঠমান্ডু পোস্ট। নেপাল সরকার পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্রে কাঠমান্ডু পোস্ট এমন তথ্য জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অবতরণের সময় আবিদ কন্ট্রোল টাওয়ারকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন এবং ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার এক ঘণ্টার ফ্লাইটে ককপিটের ভেতরে ক্রমাগত সিগারেট খেয়েছিলেন।

কাঠমান্ডু পোস্ট জানায়, ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ক্রমাগত মানসিক চাপ ও উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তার নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই ফ্লাইট বিএস২১১ বিধ্বস্ত হয়। এতে প্রাণ হারায় ৫১ জন মানুষ। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অবতরণের ছয় মিনিট আগে আবিদ সুলতান নিশ্চিত করেন উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার নামানো ও লক করা আছে। তিনি বলেন, ‘গিয়ার ডাউন, থ্রি গ্রিন’। ককপিটে থাকা ইলেক্ট্রিকাল ইন্ডিকেটর লাইটের বিষয়ে একথা বলেন তিনি।

এরপর কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ সর্বশেষ অবতরণ চেকলিস্ট পরিচালনা করেন। কিন্তু ল্যান্ডিং গিয়ার নামানো ছিল না। তার কয়েক মিনিট পরেই ৬৭ যাত্রী ও চারজন ক্রু বহনকারী উড়োজাহাজটি দ্বিতীয়বার অবতরণের চেষ্টা করার সময় রানওয়ে না পেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

তদন্তকারীরা জানায়, সুলতান এক ঘণ্টার ফ্লাইটে ক্রমাগত সিগারেট খাচ্ছিল। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এই সাবেক পাইলটের সাড়ে পাঁচ হাজার ঘণ্টা উড়ার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো এয়ারলাইন্সকে জানাননি যে তিনি ধূমাপান করেন। রিপোর্টে তদন্তকারীরা বলছেন, ককপিটের ভেতরে চূড়ান্ত মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন সুলতান। ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে তারা বলেন, ক্যাপ্টেন যে ভয়াবহ মানসিক চাপে ভুগছিলেন তা আমাদের কাছে নিশ্চিত। ঘুমের স্বল্পতার জন্য সে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত ছিল। এমনকি বারবার কাঁদছিল সে।

‘‘ভয়েস রেকর্ডারে পাইলট ও কো-পাইলটের এক ঘণ্টার কথোপকথন রেকর্ড রয়েছে। সেখানে পুরো ফ্লাইটে সুলতানের চিন্তিত মন ও পরিস্থিতির বিষয়ে সচেতনতার অভাব বোঝা গেছে। এক পর্যায়ে সুলতান বলেন, আমি নিরাপদ ফ্লাইটের কেয়ার করি না। তুমি তোমার ডিউটি করো। যদিও কাকে এটা বলেছেন তা নিশ্চিত করে বোঝা যায়নি। তবে সেসময় ককপিটে কেবল কো-পাইলটই ছিলেন। ফ্লাইটের এক পর্যায়ে পাইলট নারী কো-পাইলটকে উল্লেখ করে বলেন, তার আচরণে তিনি খুবই হতাশ হয়েছেন ও দু:খ পেয়েছেন। এই কোম্পানি ছেড়ে দেওয়ার একমাত্র কারণ তিনিই। দুর্ঘটনার একদিন আগে রিজাইন দেওয়ার ইচ্ছের কথাও জানান তিনি, যদিও কোনো লিখিত ডকুমেন্ট দেননি। তিনি বলেন, কো পাইলটের ট্রেনিং সম্পন্ন করার জন্যই আরো তিনমাস নিজের চাকরি করে যাবেন তিনি।’’

কাঠমান্ডু পোস্ট জানায়, ২০১৫ সালে ইউএস বাংলায় যোগ দেন সুলতান। এর আগেও হতাশায় আচ্ছন্ন হওয়ার ইতিহাস রয়েছে তার। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কাজ করার সময়ে তার মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণের পরে তাকে সরাসরি কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর ২০০২ সালে আবার বিশ্লেষণ শেষে ওড়ার জন্য ফিট ঘোষণা করা হয় তাকে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র ও জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেন, তাকে চাকরি দেয়ার আগে তার মেডিকেল ইতিহাস দেখা হয়নি। এরপর ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যতবারই স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে তাতে তার মানসিক অবস্থা উঠে আসেনি।

গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ ৮কিউ৪০০ উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে ছেড়ে গিয়ে দুপুর ২টা ২০মিনিটে নেপালে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের এই ঘটনায় প্রাণ হারায় ৫১ জন। এর মধ্যে ২৮ জন বাংলাদেশি, ২২ জন নেপালি এবং ১ জন চীনা নাগরিক। উড়োজাহাজটিতে থাকা ৬৭ যাত্রীর মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশী, ৩৩ জন নেপালি, একজন মালদ্বীপের এবং একজন চীনের নাগরিক ছিলেন। পাশাপাশি ৪ জন ক্রু ছিলেন।

দুর্ঘটনায় প্রথমেই মৃত্যু হয় ওই ফ্লাইটের সহকারি পাইলট এবং ইউএস বাংলার প্রথম নারী পাইলট পৃথুলা রশিদের। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদকে। পরদিন মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ক্যাপ্টেন আবিদও মারা যান।