জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার বিচারে ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালতকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত হয়নি’ বলে মনে করেন সংবিধান প্রণেতা,গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান ধরপাকড় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ড. কামাল হোসেন। সাদা পোশাকে ধরপাকড় কারা করে জানতে চেয়েছেন তিনি।মঙ্গলবার (১১ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে গণফোরাম আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ড. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, সাদা পোশাকে ধরপাকড়ের ব্যাপারে তদন্তের দরকার; এরা কারা? সাদা পোশাকে কাউকে ধরার ক্ষমতা আইনে দেওয়া নেই। মানুষ যদি সাদা পোশাকওয়ালাদের ধরে বলে তুমি কে? পোশাক দেওয়া হয় যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে তারা রাষ্ট্রের দায়িত্ববান লোক। পোশাক না পরলে মানুষ ধরে নিতে পারে- এরা হলো ছিনতাইকারী! এরা মানুষকে অন্যায়ভাবে কিডন্যাপ করছে। আইনে সাদা পোশাক পরে কাউকে গ্রেফতার করার বিধান নেই।ড. কামাল আরো বলেন, যারা ইউনিফর্ম পরে তারা একটি ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকে, তাদের পরিচয় থাকে। যাদের ধরার ক্ষমতা আছে তাদের আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। আজকে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে হয়, আমরা সাংবিধানিক শাসনের বাইরে চলে যাচ্ছি। সংবিধানের বাইরে গিয়ে করলে তা বেআইনি শাসন এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। এটা বেশি হলে আমরা গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হব। সরকারকে এ ব্যাপারে সজাগ হতে হবে যাতে এসব দ্রুত বন্ধ করা যায়।

হঠাৎ ধরপাকড় আতঙ্ক, পুরনো মামলা সচল করা, ঘটনা না ঘটলেও পুলিশের মামলা করার অভিযোগ তুলে ড. কামাল হোসেন বলেন, একটি দেশের পুলিশের ওপর আইনের সঠিক ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ আমরা আশা করতে পারি। সাংবিধানিক শাসন যেখানে থাকে সেখানে পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে। যেখানে স্বৈরতন্ত্র থাকে সেখানে ইচ্ছামত লোকজন ধরা যায়, মানুষকে গুম করা যায়। সাংবিধানিক শাসন থাকলে কাউকে ধরলে বলতে হবে- কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, জানাতে হবে, কোর্টে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করতে হবে; যাতে সে জামিন নিতে পারেন।সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, এই সরকার ধারাবাহিক না, আগের ৫ বছর ইলেক্টেড হয়ে এসেছে, পরের পাঁচ বছর একটা অনুষ্ঠান করে চালাচ্ছে। এই সরকারের বিদায় নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এটা জনগণ বিচার করবে।

জামায়াত থাকলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্য হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের দল করবে না, অন্য কোনো দল যাবে কিনা আমার জানা নেই। আমি সারাজীবনে যা করিনি তা এখনও করব না। ওরা তো এখন কোনো রাজনৈতিক দলও না। তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিচারকাজ পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরের প্রসঙ্গে বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, এখানে উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে কর্নেল তাহেরের। সামরিক শাসনে তখন কতো লোক মারা গিয়েছিল, এর মধ্যে কর্নেল তাহেরের ভূমিকা ছিল। আর তা প্রায় ৪১ বছর আগে। এত বছর আগের একটি উদাহরণ দিয়ে এটা করার কোনো মানে হয় না। যদি অভিযুক্ত হন, বিচার হয় হোক। এ ব্যাপারে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করা মানে সংবিধানকে অমান্য করা। তিনি বলেন, আমরা এটাও শুনছি যে, তার (খালেদা জিয়া) স্বাস্থ্যের কারণে তারা চাচ্ছে হাসপাতালে নেওয়া হোক। দরকার ছিল তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পাকিস্তান আমল থেকেই যে কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া একটা ঐতিহ্য আছে। যারা বিচারাধীন তাদের জন্য সব হাসপাতালেই ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের ভুলে যাওয়া উচিত না যে, আমরা একটা সভ্য সমাজে বসবাস করি। আমরা সভ্য রাষ্ট্রকে যেন অসভ্য রাষ্ট্রে পরিণত না করি।

নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি ধারা’ তৈরির প্রক্রিয়ায় থাকা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে কোনো ‘বৃহত্তর ঐক্যে’ তিনি যাবেন না।আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসা কামাল হোসেন এবং বিএনপি ছেড়ে আসা এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ঘোষণা দেন গত মাসের শেষে।কামালের গণফোরাম, বদরুদ্দোজার বিকল্পধারার সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং আ স ম রবের জেএসডি রয়েছে এই ‘জাতীয় ঐক্য’ গঠনের প্রক্রিয়ায়।তাদের একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তাদের জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া ‘জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্যে’ রূপান্তরিত হবে বলে দলটি আশা করছে।অন্যদিকে তাদের এই ভোটভুক্ত হওয়ার উদ্যোগকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ণনা করেছেন ‘আওয়ামী লীগবিরোধীদের’ এক জায়গায় আসার চেষ্টা হিসেবে।সংবাদ সম্মেলনে ড. কামালের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- জামায়াতকে রেখে বিএনপির সঙ্গে কোনো বৃহত্তর ঐক্যে তিনি যাবেন কিনা।উত্তরে তিনি বলেন, “আমি ও আমাদের দল যাবে না। অন্য কোনো দল করবে কিনা আমি জানি না।তবে আমি যতটুকু জানি, ওরা (জামায়াতে ইসলামী) তো এখন দলও না, ইতোমধ্যে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।নির্বাচনের আগে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কাজ কতটা এগিয়েছে জানতে চাইলে কামাল বলেন, এই ঐক্যের কাজ আগাচ্ছে, ঐক্য গড়ে উঠছে, আগাচ্ছে। আমরা সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই ।

আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার কথাও জানান কামাল হোসেন।এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ধারণা এটা তারা আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে। আদালত এটার বিচার করবে। আমি আদালতে গেলে এটাই বলব, এটা সংবিধানসম্মত না।

জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্র“য়ারি থেকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানি শেষ করতে কারাগারের ভেতরেই আদালত বসিয়ে তার বিচারের ব্যবস্থা করেছে সরকার।কামাল বলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রীকে আটক করেছেন। তার ব্যাপারে জেলখানায় বিচার-টিচার- এসব ঠিক নয়। বলা হচ্ছে কর্নেল তাহেরের উদাহরণ। সামরিক শাসনে সেই বিচার হয়েছে। ৪১ বছরের আগের উদাহরণ একটা দিয়ে এটা (আদালত স্থানান্তর) করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।এই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষে যাবে না বলেও মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা জগলুল হায়দার আফ্রিক, আওম শফিক উল্লাহ, সাইদুর রহমান, মোশতাক আহমদ, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আবম মোস্তফা আমিন উপস্থিত ছিলেন।