শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় অব্যাহত পদ্মার ভাঙনে সচ্ছল ও গরিব পরিবারগুলো এখন একই কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। যাদের একসময়ে ছিল বাড়ি, ছিল গাড়ি; তারা সবাই এখন ভূমিহীনদের কাতারে। বর্তমানে কেউ আত্মীয়স্বজন, কেউ অন্যের জমিতে, আবার কোনো কোনো পরিবার রাস্তার পাশে খুপরি ঘর তুলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর, কেদারপুর ইউনিয়নের ও নড়িয়া পৌরসভার ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্ত কেউ রেহাই পায়নি সর্বনাশা পদ্মার ভাঙন থেকে। গত তিন মাসে এসব এলাকার গৃহহীন হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার। গত দুদিনে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মুলফৎগঞ্জ বাজার ও বাসতলা বাজার এলাকায় ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ৩০টি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া পানের বরজ, একটি কলার বাগানসহ কয়েক একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

সরেজমিনে গত বুধবার নড়িয়া পৌরসভার ভাঙনকবলিত এলাকার বাঁশতলায় গিয়ে দেখা যায়, একটু পর পরই প্রায় ৩০-৪০ মিটার করে জায়গা নদীগর্ভে দেবে যাচ্ছে। দেবে যাওয়া জমিতে একসময় মানুষের বসতবাড়ি ছিল। ভাঙন আতঙ্কে গাছপালা কেটে ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পদ্মাপাড়ের মানুষ। আশ্রয়ের সন্ধানে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছেন তাঁরা। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনে বাঁশতলা এলাকার ২০টি বসতবাড়ির জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে দেখা যায়। দুপুরে কেদারপুর ইউনিয়নের দাশপাড়া এলাকার প্রায় ১০টি বসতবাড়ির জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একটি কলাবাগান ও পানের বরজও তলিয়ে যায় বাঁশতলা এলাকায়।আমাগো বাড়ি আছিল। বাড়িতে গাছ আছিল। আমি লাউগাছ, পুঁই লাগাইছিলাম বাড়িতে। অহন আমাগো কিছুই নাই। সব পদ্মায় ভাইঙ্গা লইছে। অহন আমরা ঘর বাড়ি লইয়া এহানে আইয়া রইছি। মনার বাবায় (স্বামী) গেছে জমি ঠিক করতে। জমি ঠিক করতে পারলে আমরা ওই হানে চইলা যামু। আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন কেদারপুর ইউনিয়নের মুলফৎগঞ্জ বাজারের পাশে মজিদশাহ দরবার শরিফের পাশে মাঠে আশ্রয় নেওয়া লাকী বেগম। একটি খোলা জমিতে দুটি চাল তুলে দুই মাস বয়সী শিশুসন্তান রাহিমাকে নিয়ে বসেছিলেন তিনি। কেদারপুর ইউনিয়নের দাশপাড়া গ্রামে একটি ভাড়া করা জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিলেন তাঁরা। বুধবার দুপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে সেই জমি। ঘর ও আসবাবপত্র নিয়ে ওই মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।

চারদিকে ছোটাছুটি করে বিলাপ করছিলেন বৃদ্ধা। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার অনেকটি জমি আছিল। আমার অহন কিছুই থাকল না। সব লইয়া গেল। পনের গণ্ডা জমি আছিল আমার। কুঁড়ি গাছ গেলগা। সুবরির চারাডিও গেলগা। বুড়ায় কোনো কাম করতে পারে না। অহন আমি কী করুম? কই থাকুম? আমার পোলায় গরিব হয়া গেল (হাহাকার করে ওঠেন)। আমিও গরিব অইয়া গেলাম।’ তিনি নড়িয়া পৌরসভার বাঁশতলা গ্রামের বাসিন্দা।কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফরিদা বেগম বলেন, বুধবার বিকেলের ভাঙনে চোখের সামনেই আমার বসতবাড়িটি নদীতে বিলীন হয়ে গেল। এই বাড়িটিইে ৪৫ বছর আগে বউ হয়ে এসেছিলাম আমি। নিজের সাজানো- গোছানো বাড়িটি চোখের সামনে বিলীন হয়ে যেতে থেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রাফিক কাজী বলেন, আমি ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য। চরজুজিরা গ্রামে ছিল আমার বাড়ি। আমি ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হলেও আমি এখন বসবাস করছি অন্য ওয়ার্ডে। পুরো ওয়ার্ডটিই এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।শুধু তাঁরাই নন, নড়িয়া উপজেলার হাজারো মানুষের ভাগ্যে এখন একই পরিণতি হয়েছে।নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানজিদা ইয়াছমিন বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। গৃহহীন পরিবারগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। সরকারি খাস জমি দেখে গৃহহীনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।