সাগর গরম। ঘন ঘন নি¤œচাপ।¯্রােতের চাপ বেশি। দুই-তিন দিন পর পর সীগন্যাল। বোট চালানোর উপায় নেই। গেল দেড় মাসে অন্তত কুড়ি বার আবহাওয়া খারাপ হয়েছে। এমনসব মন্তব্য করে জানালেন, ট্রলার মাঝি নিজাম উদ্দিন। গত ১৮ বছরে এমন বাজে অবস্থা তিনি আর দেখেননি। মিহির দাসের নম্বরবিহীন একটি ফিশিং বোটে কাজ করেন এ মানুষটি। একই কথা জেলে আবু জাফরের। জানালেন এরা, এমনিতেই এখন ইলিশ পাওয়া যায় অনেক গভীর সাগরে। চালনার বয়ার পরে। চরম ঝুঁকি নিয়ে সাগরে যাওয়ার দুইদিন পরেই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। কিছু ইলিশ নিয়ে ফিরে আসতে হয়, কখনও খালি হাতে।

এক-দুই বার জাল পাতার সুযোগ মেলে। অথচ একেকবারে সাগরে যেতে ৫০-৬০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকার বাজার করতে হয় ।বরফ, খাবার ও জ¦ালানিসহ এই খরচ লাগে। যেখানে ৮-১০দিন থাকার কথা সাগরে। তাইলে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত তাতে লোকসান হতোনা। এফবি লিমা বোটে এখন বাবুর্চির কাজ করেন ছোহরাব হোসেন। জানালেন বয়োবৃদ্ধ এ মানুষটি, দেশ স্বাধীনের এক বছর পর থেকে বোটে কাজ করেন। ১৬ কি ১৭ বছর বয়সে শুরু। টানা ১৯টি বছর মাঝি ছিলেন। মৌডুবির এক মালিকের বোটে এখন আছেন। স্মৃতি হাঁতড়ে জানালেন, তখন বরফ ছিল না। কাটারুর কাছে ইলিশ বিক্রি করতেন। লবন দিয়ে সংরক্ষণ করত। তখনও ৫০/৬০ মন ইলিশ পেতেন একবারে। অনেক কিনারে মাছ ধরতেন। এখন গহীন সাগরে যেতে হয়। ঝড়-ঝাপটাসহ ডাকাতের কবলে পড়েছেন। সাগরে ভেসেছেন। বললেন ছোহরাব হোসেন, র‌্যাবের কারণে ডাকাইত নেই বললেই চলে। ভয় কাইট্যা গেছে। কিন্তু সাগর যেন ক্যামন অইয়া গ্যাছে।’ জানালেন, গত এক মাসে অন্তত আটটি বোট ডুবেছে। এখনও সাত জেলে নিখোঁজ রয়েছে। হাজারো ফিশিং ট্রলার শিববাড়িয়ার চ্যানেলের আলীপুর-মহিপুর বন্দরে ভিড়ে আছে। সবার ভাষ্য এক। মাছ আছে। ধরতে পারছেন না। অন্তত ৩০ হাজার জেলে। দুই শ’ আড়তমালিক। অর্ধশত বরফকল মালিকসহ ৫০ হাজার পরিবারে এখন শঙ্কা বিরাজ করছে লোকসানের। এসময় গেল বছর প্রত্যেক ট্রলারের গড়ে লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে। এবছর এরা শতকরা ৯০ জনে লাভের মুখ দেখতে পারেনি। উল্টো লোকসানের ধকল বইছেন। নিজাম মাঝি জানালেন, যদিও তারা বেতনভোগী। তারপরও মনে শান্তি নেই। মালিকের লাভ না থাকলে কারও মন-মেজাজ ভাল থাকে না। মহিপুর মৎস্য আড়ত ও ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গাজী ফজলুর রহমান জানালেন, ধার-দেনায় কাহিল অধিকাংশ বোট মালিক। ১০-১২ দিনের বাজার নিয়ে সাগরে গিয়ে দুই দিনও থাকতে পারেনা জেলেরা।

এমন কোন গোন (জো) নেই একবারে দুইদিনের বেশি সাগরে অবস্থান করতে পারছে। তাঁর দাবি এমনিতেই এবছর ইলিশ কম ধরা পড়ছে। তার ওপরে এত বেশি সাগর উত্তাল আগে কখনও দেখেননি। তাঁর মতে একেকটি আড়তের কমপক্ষে ১০ থেখে ৫০ লাখ টাকার দেনায় পড়েছে। গেল বছর এমন সময় আড়তে ছিল ইলিশ আর ইলিশ। আর এবছর নেই কোন ভিড় কিংবা বেচাকেনার প্রাণচাঞ্চল্য। দৈনিক দুইটি ট্রাকও ফুললোড দিয়ে ইলিশ নিয়ে মোকামে পাঠাতে পারছেন না। শিববাড়িয়া নদীর দুই পাড়ে আলীপুর ও মহিপুর এবং কুয়াকাটার মোকামে অন্তত ৮০টি আড়ত রয়েছে। কিন্তু ইলিশের ভরা মৌসুমে নেই মাছের আমদানি। সকলের ভাষ্য এক আবহওয়া খুব খারাপ। ঘন ঘন নি¤œচাপ। প্রচন্ড উত্তাল থাকছে সাগর। ৩৫-৪০টি বরফকলেও নেই তেমন বেচাকেনা। শ্রমিকরাও বেকার হয়ে আছে। জ¦ালানিসহ জেলেদের সঙ্গে সম্পর্কিত দোকানগুলোয় নেই বেচাকেনা। এক কথায় দক্ষিণের অন্যতম ইলিশের মোকাম মহিপুর-আলীপুরে বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা। আড়তমালিকসহ হাজার হাজার জেলে পরিবারে চরম উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। সকলে একই কথা সাগর খুব বেশি গরম। এমনটা তাঁরা গত ২০ বছরে দেখেননি। পেশায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সহকারী পরিচালক মোঃ আসাদুজ্জামান খান জানান, সাগরে প্রচন্ড ঢেউ থাকছে। এবছর খুব বেশি। তার মতামত জলবায়ূর পরিবর্তনজনিত কারণে এটি হচ্ছে। আর সাগরে ট্রলার ডুবিতে প্রাণহানি এড়াতে বারবার সতর্ক সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে জেলে, ট্রলার মালিক, আতদারসহ এ পেশা সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার পরিবারে লোকসানের শঙ্কা বিরাজ করছে। জেলেসহ সকলের দাবি ইলিশ ধরার আসন্ন নিষেধাজ্ঞার সময়কাল পেছানো হোক।