কক্সবাজারের রামু উপজেলার বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার, বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। এসব ঘটনায় দায়ের করা ১৮টি মামলার একটিরও বিচারকাজ শেষ হয়নি। উপরন্তু সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভয়ে অনেকেই মামলায় সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না। ফলে বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে।

উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবক সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননা করেছেন- এমন অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রতœতাত্ত্বিক সব নিদর্শন। যদিও এই নামের কোনো যুবককে প্রশাসন চিহ্নিত করতে পারেনি।

এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুটি মামলা হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে। এর মধ্যে এজাহারভূক্ত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। পরবর্তী সময়ে এসব মামলায় ৯৯৫ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে রামু থানার আটটি মামলায় ৪৫৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পরিদর্শক কাজী দিদারুল ইসলাম গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমকে বলেন, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুই পক্ষের মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। ১৮টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেওয়া হয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পিবিআই।

আদালত পরিদর্শক বলেন, ১৮টি মামলার মধ্যে বর্তমানে ১৪টি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। চারটি মামলা ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৪২৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। পলাতক আছেন ১০৬ জন।জানা গেছে, রামুর উখিয়ারঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার একটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইয়ের কাছে পাঠানো হয়।পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কক্সবাজারের পরিদর্শক কৈশানু মার্মা এ ব্যাপারে বলেন, পাঁচটি মামলা পিবিআইয়ের কাছে পাঠানো হলেও এর মধ্যে চারটি মামলা অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি একটি মামলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশনা ছিল আদালতের। কিন্তু ওই সময় এ পদ মর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কক্সবাজার পিবিআইয়ে না থাকায় তদন্ত কাজ করা যায়নি। তাই পরবর্তী সময়ে জবাব লিখে মামলাটি আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।মামলার সাক্ষী না থাকা প্রসঙ্গে পিবিআইয়ের পরিদর্শক আরো বলেন, সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে মনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । আদালত চাইলে তাদের শাস্তি দিতে পারেন।কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মমতাজ উদ্দিন বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলার সাক্ষী বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় এসব মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।

রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক রজত বড়ুয়া রিকু বলেন, ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে তার কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায় জানে না। এমনকি যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও প্রকৃত অপরাধীদের অনেকের নাম অভিযোগপত্রে আসেনি। এ অবস্থায় ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।ঘটনার পর সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অনেক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন বৌদ্ধ বিহার ও বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অনেককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ এই বিচার নিয়ে চিন্তিত’, যোগ করেন রজত বড়ুয়া রিকু।কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ‘এই ছয় বছরে আমরা ভাঙ্গা-গড়া, উত্থান-পতন অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল, তা আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠা যাচ্ছে। তবে পুরোটা ফিরে আসতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি সম্প্রীতির জায়গাটাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে। সেটি হতে পারে সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, বর্তমানে মামলাগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নিরাপত্তা বিষয়টি ভেবে অনেকেই স্বাক্ষী দিতে রাজি হচ্ছেন না। সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পুলিশের। যদি সাক্ষীদের হুমকি-ধমকির কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এ দিকে বিভীষিকাময় সহিংসতার ছয় বছর স্মরণে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ শ্রীকুল লাল চিং-মৈত্রী কমপ্লেক্স চত্বরে আজ শনিবার দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দান, ধর্মসভা, দুপুর ১২টায় অতিথি ভোজন, দুপুর ২টায় মৈত্রী শোভাযাত্রা, বেলা ৩টায় ধর্মসভা এবং বিকেল ৫টায় দেশ ও বিশ্বশান্তি কামনায় হাজার প্রদীপ প্রজ্বালন ও সমবেত প্রার্থনা। স্মরণানুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন একুশে পদকপ্রাপ্ত রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ উপসংঘরাজ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরো।