বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার কথা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সিনহা শনিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে তার নতুন বইয়ের প্রকাশন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান।

তিনি বলেন, আসলে এখন পর্যন্ত এখানে আমার কোনো স্ট্যাটাস নেই। আমি একজন শরণার্থী। ভিসা শেষ হলে আমি যেন থাকতে পারি, সেজন্য এখানকার কর্তৃপক্ষকে হয়ত সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করব। এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছি, কিন্তু এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।শরণার্থী অবস্থায় থাকায় এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের অনুমতি নেই জানিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, যুক্তরাজ্য, জেনিভা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ থাকলেও এই অবস্থার কারণে তিনি যেতে পারছেন না।সিনহা দাবি করেন, এই বই প্রকাশে রাজনৈতিক অঙ্গনের কারও কাছ থেকে তিনি কোনো সহযোগিতা নেননি। আর নিজের অভিজ্ঞতার কারণে রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন।

ওয়াশিংটন ডিসির নাশনাল প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সিনিয়র পলিসি স্কলার উইলিয়াম বি মাইলাম। দর্শকসারিতে ছিলেন খালেদা জিয়ার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি মুশফিক ফজল আনসারী।রাইট টু ফ্রিডম’ নামের এক সংগঠনের ব্যানারে এ অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে উপস্থিত ছিলেন ডজনখানেক লোক। আমন্ত্রিতদের বাইরে কাওকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলে এস কে সিনহার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিতাংশু গুহ জানিয়েছেন। দেড় ঘণ্টার এ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার কোনো সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিকেও দেখা যায়নি।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।এর এক বছরের মাথায় তিনি বিদেশে বসে এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন যা নিয়ে আলোচনা চলছে।বইতে সিনহা লিখেছেন, ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক এক রায় দেওয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে।প্রকাশনা অনুষ্ঠানেও তিনি শেখ হাসিনার সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। সিনহা বলেন, দেশে ফিরলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে তাকে মেরে ফেলবে না, সে নিশ্চয়তা নেই।

বক্তব্যের শুরুতে সিনহা বলেন, অনেক বাধার পর আমি বইটা প্রকাশ করতে পেরেছি, আপনাদের সামনে আসতে পেরেছি, সেজন আমি আনন্দিত। আমার মোটো কী ছিল, আমি কী করতে চেয়েছিলাম, আর প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসার পর আমি কি দেখলাম- তা এই বইয়ে তুলে ধরেছি।তিনি দাবি করেন, বইটি প্রকাশ করার জন্য শুরুতে তিনি কারও কাছ থেকে সহযোগিতা অর্থায়ন পাননি, কোনো অর্থায়ন পাননি এমনকি প্রকাশকও পাননি । যারা তাকে সমর্থন করেছেন, তারাও ‘সরকারের চাপের কারণে’ তাকে ছেড়ে গেছেন।

শেষ পর্যন্ত কিছু বন্ধু পরোক্ষভাবে বইটি প্রকাশে সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, তাদের নাম তিনি বইয়ের ভূমিকায় লেখননি, কারণ দেশে আত্মীয় স্বজনের সমস্যা হতে পারে’ মনে করে তারা নাম না দিতে অনুরোধ করেছেন। সেভাবে কারও ‘সহযোগিতা না পাওয়ায়’ এ বইয়ে বেশকিছু ভুল-ত্রুটি রয়েছে গেছে এবং নির্ঘণ্টও তৈরি করতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি সিনহা।তিনি বলেন, শিগগিরই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হবে, সেখানে এসব ত্রুটি সংশোধনের পাশাপাশি ‘আরও অনেক তথ্য’ সন্নিবেশিত হবে।যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, নিউ ইয়র্কের জামায়াতপন্থিরা এস কে সিনহার বইয়ের প্রচারের জন্য কাজ করছে। বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সাহায্য পেয়েছেন সিনহা।এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত শুক্রবার নিউ ইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আপনারা একটু খুঁজে বের করেন না, বইটা লেখার পেছনে কার হাত আছে? এই বইটার পাণ্ডুলিপি কতবার বাংলাদেশে গেছে? কার কাছে গেছে বা তিনি যে লঞ্চটা করবেন; এই লঞ্চিংয়ের টাকা-পয়সা খরচটা কে দিচ্ছে?

বাংলাদেশ থেকে কেউ দিচ্ছে কিনা বা আপনাদের মতো কোনো সাংবাদিকরা এর পেছনে আছে কিনা? কোনো সংবাদপত্র আছে কিনা বা তারা কতটুকু সাহায্যপত্র দিচ্ছে? আমাদের কোনো আইনজীবী এর স্ক্রিপ্ট দেখে দিচ্ছে কিনা? কোন পত্রিকা বা পত্রিকার মালিকরা তাকে এই মদদটা দিচ্ছে? স্ক্রিপ্টটা লেখার ব্যাপারে কোনো সাংবাদিক, কোন পত্রিকার, কে এটা সাহায্য করছে?এ বিষয়ে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি সিনহা বলেন, আমি কখনও রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না, আমি রাজনীতি ঘৃণা করি, কারণ যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৭৪ সাল থেকে আমি দেখছিৃ আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা নিইনি।

সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন,সরকার অভিযোগ করছে, কিছু রাজনৈতিক দল আমাকে সাহায্য করছে। এমনকি এও বলেছেন, লন্ডন থেকে জামায়াতে ইসলামীর একজন, ব্যারিস্টার রাজ্জাক আমাকে সাহায্য করেছে।রাজনৈতিক কেউ আমাকে এ কাজে সহযোগিতা করেনি। কেবল কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেন, যারা ডক্টর, প্রফেসর, জার্নালিস্ট আমাকে হেল্প করেছেন।বইটি প্রকাশে একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, বইটি প্রকাশ করেছে অ্যামাজন।

পদত্যাগের পর দেশে সরকারের তরফ থেকে বিচারপতি সিনহার যেসব দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে, সেসব বিষয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া এ অনুষ্ঠানে পাওয়া যায়নি।তিনি বলেন, আমি লড়ছি আইনের শাসনের জন্যে, গণতন্ত্রের জন্যে, মানবাধিকারের জন্যে। কারণ আমার এখন আমাদের দেশে কিছু প্রকাশ করতে পারি না।আপনারা দেখবেন, কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই দুই থেকে তিনশ সাংবাদিক রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন, কারণ তারা স্বাধীনভাবে কিছু লিখেছিলেন।তার ভাষায়, মহান যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশে মানবাধিকার সংরক্ষিত বলেই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ তার হচ্ছে।নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করে যাওয়া উইলিয়াম মাইলাম তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, তিনি এখনও বইটি পড়েননি। তবে কিছু কিছু বিষয় তার দৃষ্টি গোচর হয়েছে।বাংলাদেশে আইনের শাসনের অবনতি ঘটার খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে বিচারপতি সিনহার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে ওয়াশিংটনে বাসবাসরত আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজন ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে গেলেও আমন্ত্রণপত্র না থাকায় তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেট্রো ওয়াশিংটন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদেক খান বলেন, নিজে দুর্নীতিবাজ, বিশেষ মহলের মদদে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন এস কে সিনহা। এজন্য আমাদেরকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হল না।