আর কিছুক্ষণ পর মৌমিতার জীবন প্রদ্বীপ নিভে যাবে।হাসপাতালে লাইফ সাফোর্টে ডাক্তারের নিভীর পর্যবেক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে একটু পরই সে ছাড়পত্র পেয়ে বসবে। দেহে প্রাণের অস্তিত্ব বর্তমান থাকলেও তাতে কোনো স্পন্দন নেই। চোখের পাতা খোলার সামর্থ্যটুকুও কেউ যেন কেড়ে নিতে চাইছে । কিন্তু বদ্ধ পাতার অক্ষি যুগলের ভেতরকার স্বপ্ন গুলো আজ মৌমিতাকে ইলেকট্রিক শকের মতো ঝাঁকুনি দিচ্ছে। মুখ দিয়ে বিড় বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে সে। হয়তো চোখের ভেতরকার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো আর জান কবজকারীর মধ্যে বাকবতিন্ডা হচ্ছে। স্বপ্নগুলো চাচ্ছে পূরণ হয়ে মৌমিতার কাছে ধরা দিবে। আর হরণকারী বলছে এক মূহুর্তও না।

মোহন শিকদার পাশে বসে ঝিমুচ্ছেন। চোখ দিয়ে তার মনের অজান্তেই ঝড়ছে অশ্রু নামক বৃষ্টির ধারা। বৃষ্টি অবশ্য বাহিরেও হচ্ছে। শ্রাবণ গগণের ঘন মেঘের বৃষ্টি। চারদিকে অন্ধকার, হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি। আকাশের কপাট বুঝি খুলে গেছে। তারই ধারায় ধরণী এক্ষুণি ডুবে যেতে চায়।
জগতে আপন বলতে মৌমিতার বাবা মোহন শিকদার আর ছেল হাসুই ছিল অন্ধের যষ্টি। হাসু খবর পেয়েছিল দিন থাকতেই তার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের কাছে। কিন্তুু ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে খুলনার বাস ধরতে ঢের দেরী হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে বাস ছাড়লো খুলনার উদ্দেশ্যে। ঝড়ের গতিতে চলছে বাস। কিন্তু ভোর হওয়ার পূর্বে খুলনা পৌঁছানোটা কখনোই সম্ভব ছিল না।

মৌমিতার স্বপ্নগুলোতো সেদিনই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, যেদিন তার কিশর বয়সের স্বামী তাকে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল অজ্ঞাত না ফেরার দেশে। আর উপহার স্বরুপ দিয়ে গিয়েছিল ছয় মাসের আদরের হাসুকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ইচ্ছা করলে সে তার ভঙ্গা তরী মেরামত করে সুখের সায়রে নিজেকে ভাসাতে পারতো ঠিকই। কিন্তু একমাত্র হাসুর মুখপানে চেয়ে সুখের কথা না ভেবে বেছে নিল এক অনন্ত সংগ্রামের পথ। আর স্বপ্ন গুলোকে সেলাই করা শুরু করলো সেদিন থেকেই যেদিন হাসু পাঠ্যবই নিয়ে পড়া শুরু করেছিল অ আ ক খ।

স্বামীকে হারিয়ে মৌমিতা পরোপুরি ভেঙ্গে পড়েনি সত্য, তবে যে আর্থিক সংকট তার বর্তমান ছিল তা কাটিয়ে উঠাটাই ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এদিকে শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও দূর্বলতার সুযোগে তাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করলো। সব হারিয়ে যখন সে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো তখন অস্বচ্ছল বৃদ্ধ বাবাই ছিল শেষ ভরসা। কিন্তুু না….সহজে দমবার পাত্র নয় মৌমিতা। বাবার ঘাড়ে বোঝা না হয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে জোগাড় করতো দুটি প্রাণীর বেঁচে থাকার অন্ন। আর এভাবেই চলতে লাগলো সর্বহারা মনুষ্য প্রাণী দুটির জীবন সংগ্রাম।

হাসুটাও তার বাবার মতোই মেধাবী হয়েছিল। বিদ্যা, বুদ্ধি, এবং যুক্তিতে ঠিক তার বাবারই সমতুল্য। মৌমিতার স্বামী ছিল সরকারী চাকুরিজীবি। সবে মাত্র পাড়ার স্কুলের সহকারী শিক্ষক থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষকে পদোন্নতি হয়েছিল। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বিধাতার বিধির কাছে হার না মেনে পারল না। হাসুর মা হাসুকে দেখত আর স্বামীর কথা স্বরণ করে আঁচলে চোখ ভেজাত। ছোট্ট হাসুও তখন ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতো। কে জানতো তার এতটুকু মনের মাঝেও যে লুকিয়ে ছিল কত ব্যাথা। একসময় মা ছেলের আহাজারিতে ভারী হয়ে আসতো চারদিকের বাতাস।

এদিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাসু কলেজ পর্যায়ও শেষ করে ফেলল। গ্রামের অন্য দশটা ছেলের চাইতে মেধা, মন মানসিকতায় সে ছিল ব্যতিক্রম। হাসুকে নিয়ে মায়ের চিন্তা আগের চেয়ে আরো দ্বিগুন বেড়ে গেল। এতোদিন ধার দেনা করে পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলের লেখাপড়ার জোগান দিয়েছে। আজ ছেলের উচ্চ শিক্ষার খরচের কথা ভাবতেই যেন শিরার কম্পন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কিন্তুু স্বপ্নের কাছে মৌমিতা অনঢ়। স্বামীর হাতের শেষ স্মৃতি একজোড়া কানের দুল বিক্রি করে ছেলেকে সুযোগ করে দিল ভর্তি পরীক্ষায় লড়ার। মেধা আর শ্রমকে কাজে লাগিয়ে হাসু দেশর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আইন বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেল। সন্তানের সাফল্যে মায়ের চোখের কোণায় সেদিন এক ফোটা জল ভিন্ন অন্য কিছু দেখা না গেলেও দেখা গিয়েছিল এক অপার সম্ভাবনা।

শুরু হলো হাসুর উচ্চ শিক্ষা তথা মায়ের স্বপ্ন পূরণের জীবন।ঢাকায় ভালো একটা টিউশনিও জুটে গেল তার। খেয়ে পড়ে অবশিষ্ট যা থাকতো তা জমিয়ে মায়ের জন্য ভালো একটা শাড়ি আর কিছু খাবার না নিতে পারলে সেই বারের যাত্রাটাই যেন বৃথা হতো তার। এভাবেই চলতে লাগলো হাসুর জীবন সংগ্রাম। মৌমিতার স্বপ্ন ছিল তার ছেলে একদিন অনেক বড় বিচারক হবে। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। তার স্বামীর হারানো সম্পত্তি উদ্ধার করবে। আর তখন সে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে আমার ত্যাগ আজ স্বার্থক হয়েছে।

না… এভাবে আর কতক্ষণ? হরণকারীর যে আর তর সইছে না। ঘড়ির কাঁটাও যেন শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বাহিরে বর্ষণ কমবার জো নেই। দুঃখের রজনী আসলেই অনেক দীর্ঘ। শেষ হতে কাপূর্ণ্য বোধ করে। কিন্তু না… অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটল। মিনার থেকে মুয়াজ্জীনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। মোহন শিকদার আড়মোড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এক্ষুণি নামাজের জন্য বের হবেন। তার আগে মেয়ের মাথায় স্নেহের হাতখানা ছোঁয়ানোর অপেক্ষায়। এমন সময় অস্পষ্ট স্বরে মৌমিতা একবার বাবা বলে ডাকলো। বাবার কলিজায় তৃষ্ণার জল পড়ল। ভাবলেন মেয়ে শঙ্কামুক্ত। কিন্তুু পরক্ষণেই তার ভাবনা মরীচিকার মতো মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। উর্ধশ্বাসে কয়েকবার হাসুকে ডাকলো মৌমিতা। মোহন শিকদার পাগলের মতো ডাক্তার ডাক্তার বলে দৌড়াতে লাগলেন। ডাক্তার আসলেন, কিন্তুু ততক্ষণে তার দেহ মিলিয়ে গেল হাসপাতালের বেডে। সে হেরে গেল তার অপূর্ণ স্বপ্নের কাছে।

বাস খুলনা এসে থামলো। সারা রাত্রি জাগা হাসু পাগলের মতো ছুটতে লাগলো হাসপাতালের দিকে। যতো বেগে সে এগোয় তার চেয়ে দ্বিগুন বেগে কেউ যেন তাকে পিছু টানে আর বলে, এতো তাড়া কিসের, যার জন্য যাচ্ছ সে সবে মাত্র চলে গেছে। মনের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে হাসু যখন আই সি ইউ কক্ষের সামনে পৌঁছায় ততক্ষণে দুই জন নার্স মৌমিতাকে বের করে নিয়ে আসছিল। অর্থাৎ সে ছাড়পত্র পেয়ে গেল। হাসুর হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলনা সে। চাপা শোকে পাথর হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। যেই মা তার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে, নিজের স্বাদ আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জন্য সব উজার করে দিয়েছে। সেই মা আজ তার স্বপ্ন পুরণের শেষ প্রান্তে এসে তাকে একা করে চলে গেল। বোধ হয় বিধাতার রীতিটাই এমন। মায়ের কপালে সুখ সয়না। আসলে মায়েদের স্বপ্নগুলো পূর্ণ হয় ঠিকই। কিন্তুু সেটা তাঁদের জীবদ্দশায় না, মৃত্যুর ঠিক কিছুদিন পর। তা না হলে একটা সন্তান যেদিন চাকুরির প্রথম বেতন দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ী কিনে নিবে সেদিন তাকে নিতে হয় সাদা কাপনের কাপড়। যেদিন সে হেসে হেসে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তি জুড়াবে সেদিন তাকে কান্নায় গা ভাসাতে হয়।
তোমরা অনন্তকাল বেঁচে থাকো মা। আমাদের একটু সুখের জন্য তোমরা কতটা কষ্ট দিয়েছ নিজেকে। অথচ আজ তোমাদের সুখের দিনে তোমরা থাকবেনা, একথা ভাবতেই যে বুক ফেটে যায়। শুনেছি হাসু জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেছে। মায়ের স্বপ্ন পূর্ণ করেছে। কিন্তু সে স্বপ্নতো আজো মায়ের নিকট অপূর্ণ।

অপূর্ণ স্বপ্ন -শফিউল আল শামীম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ,ঢাকা কলেজ

সম্পাদকীয় সদস্য,বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক সংঘ।