ফারমার্স ব্যংকের দুইটি একাউন্ট থেকে চার কোটি টাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার লেনদনের ঘটনায় অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সুনির্দিষ্ট করে কারও নাম না বললেও অনেকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক। বৃহস্পতিবার (৪ অক্টোবর) বিকেলে দুদকের সেগুনবাগিচা কার্যালয়ে চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের একথা বলেন।দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের দু’টি একাউন্ট থেকে চার কোটি টাকা ঋণের ব্যাপারে আমরা তদন্ত করেছি। তদন্ত শেষ হয়ে গেছে। অনেকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বা চিহ্নিত করা হয়েছে। ঋণ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সেখানে অনেকেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। আমরা সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করছি।

সাবেক প্রধান বিচারপতির জড়িত কিনা এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থাকুক আর যেই থাকুক যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বা যাবে তাদের বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির নাম বলতে রাজি হয়নি দুদক প্রধান।তিনি বলেন, দু’টি একাউন্ট থেকে ঋণ প্রক্রিয়া এবং এই টাকা মানিলন্ডারিং বা বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, নগদ উত্তোলন এসব বিষয়ে অনেক কিছু এসেছে।দুদকের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যা হয়, তাই হবে। যদি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে আইন অনুযায়ী মামলা হবে।প্রসঙ্গত,ফারমার্স ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা এবং মোহাম্মদ শাহজাহান ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে একইদিনে ২ কোটি করে ৪ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। ওইদিনই তারা টাকাগুলো পে-অর্ডারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা) অ্যাকাউন্টে জমা দেন। এরপর সেই অ্যাকাউন্ট থেকে একইদিন টাকাগুলো তুলে আত্মসাৎ করা হয়।সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার করা মামলার নথি পাওয়ার পর তদন্ত শুরুর কথা বলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। মামলার এফআইআর আসছেৃ.এখন এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বিচার বিশ্লেষণ করবে। আইনের বাইরে যাওয়া যাবে না।পরে দুপুরের দিকে কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা জানান দুদকের এক কর্মকর্তা।আর এ তদন্তের তদারক করবেন মহাপরিচালক খান মো. নুরুল আমিন।

বিএনপি ছেড়ে আসার পর এখন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা গত ২৭ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ওই মামলা দায়ের করেন।প্রধান বিচারপতি থাকাকালে সিনহা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং খাস কামরায় ডেকে সোয়া তিন কোটি টাকা উৎকোচ দাবি করেছিলেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন হুদা।মামলাটি ‘দুদক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ’ মনে করায় তা দুদকে পাঠিয়ে দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ।এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা কী করবেন তা আমি বলতে পারব না। আমি তো অভিযোগ বিচার বিশ্লেষণ এখনও করতে পারিনি। এটি আদালতের মাধ্যমে দুদকে এসেছে। আদালত তো কিছু না বুঝে আমাদের দেয়নি।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন, তাহলে তিনি এস কে সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্যোগ নেবেন। কীভাবে সেটা করা হবে তা তদন্ত কর্মকর্তা ঠিক করবেন। তবে মামলার তদন্তে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার বাধ্যবাধকতা নেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের রোষের মুখে থাকা বিচারপতি সিনহা গত বছরে অক্টোবরে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।এক বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রে বসে একটি বই প্রকাশ করে তিনি নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, সরকার তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’ পাঠিয়েছে।গত শনিবার ওয়াশিংটনে ওই বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি সিনহা বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করলেও এখনও তার ফয়সালা হয়নি। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

আর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সিনহার বই প্রকাশের পর তার ভাই অনন্ত কুমার সিনহার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার একটি অভিযোগের অনুসন্ধানে নামার কথা জানায় দুদক।সাবেক প্রধান বিচারপতিকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশের আইনে সব ব্যবস্থা রয়েছে। আনার প্রক্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে আছে। তবে এটা অনেক পরের বিষয়।ফারমার্স ব্যাংক থেকে নেওয়া দুই ব্যবসায়ীর ঋণের চার কোটি টাকা এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান।তিনি বলেন, এ অনুসন্ধানে যার নাম আসুক, বা যেই জড়িত হোক, আমরা আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেব।আর এস কে সিনহার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আপনাদের কাছে থেকে যতটুকু তথ্য পাওয়া (গণমাধ্যম) গেছে, সেখানে দেখা যায় দুই লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারে একটি বাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। আমরা যতটুকু বুঝেছি, দুই বছর আগে যখন কোনো ব্যাক্তি কোনো দেশে যান, তাহলে তার পক্ষে নাগরিক হওয়া সম্ভব না। যেহেতু তিনি নাগরিক হতে পারেননি, সেহেতু তার অবৈধ সম্পদ দেখার বিষয়টি আমাদের দায়িত্ব। সেই কারণে অনন্ত কুমার সিনহার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছি।