১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর চারনেতাকেও ষড়যন্ত্র করে কারাগারে হত্যা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্যে দিবালোকে ঘটনাস্তলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্পেশালাইজড মরণাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

বুধবার (১০ অক্টোবর) আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে বিচারক এসব কথা বলেন। দুপুরে রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, রাজনীতিতে অবশ্যাম্ভীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্ব শূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই থাকবেন, বিরোধী দলের তাদের উদার-নীতি, নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

আদালত বলেন, বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। সাধারণ জনগণ এ রাজনীতি চায় না। সাধারণ জনগণ চায় যে কোনো রাজনৈতিক দলের সভা, সমাবেশে যোগ দিয়ে সেই দলের নীতি, আদর্শ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ধারণ করা। আর সেই সভা সমাবেশে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণকে হত্যার এ ধারা চালু থাকলে পরবর্তীতে দেশের সাধারণ জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে।আদালত বলেন, আদালত চায় না সিলেটে হযরত শাহজালালর (রহ.) এর দরগা শরীফের ঘটনা, সাবের্ক অর্থমন্ত্রী এসএম কিবরিয়ার উপর নৃশংস হামলা, রমনা বটমূলে সংঘটিত বোমা হামলা এবং এ মামলার মোকদ্দমার ঘটনায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার পুনরাবৃত্তি।পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, ঘটনার (২১ আগস্ট হামলা) আগে বিভিন্ন সময় জায়গায় এ মামলার আসামিরা অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সভা করে পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪জনকে হত্যা করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশন পক্ষ সক্ষম হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে আসামিদের শাস্তি প্রদান যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন আদালত।

রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লূৎফজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯জনকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর মামলার আরও ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ১৭জন কারাগারে আছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।আর পলাতক দুইজন হলেন- আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই ও জঙ্গি নেতা মাওলানা মো. তাজউদ্দীন এবং হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ।

আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন- শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল (উপস্থিত), মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব (উপস্থিত), মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির (উপস্থিত), আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক (উপস্থিত), হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া (উপস্থিত), আবু বকর ওরফে হাফে সেলিম হাওলাদার (উপস্থিত), মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ (উপস্থিত), মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) এবং রাতুল আহম্মেদ বাবু ওরফে বাবু ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক)।২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন মারা যান। আহত হন কয়েক শ’ নেতা-কর্মী। ওই দিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, তবে তার কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরীরে এখনও সেই ভয়াল ক্ষত নিয়ে দিনাতিপাত করছেন অনেকে।