বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি বলছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন ও বিএনপিকে দুর্বল করার অসৎ উদ্দেশ্য। তাই এই রায়ের ভিত্তিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের প্রশ্ন আসে না।শুক্রবার সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম এ মন্তব্য করেন।ফখরুল বলেন, গতকাল প্রকাশিত দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় হামলা বলে আদালতের পর্যবেক্ষণের যে খবর প্রচারিত হয়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক বক্তব্যের হুবহু প্রতিফলন দেখে দেশের জনগণের মতো আমরাও বিস্মিত হয়েছি।’

ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি যে, গণমাধ্যমের একাংশ এই রায় প্রকাশের পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে মনগড়া কিছু তত্ত্ব ও তথ্য প্রকাশ করে তাঁর সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণা দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দলীয় তদন্তকারীর চক্রান্তে সাজানো মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এটা জানার পরেও কেউ কেউ দল থেকে তাঁর পদত্যাগের যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাদের কাছে জনগণ প্রশ্ন করতে পারে যে, এত শত গুম, খুন করার জন্য দায়ী সরকারের পদত্যাগ কি তারা দাবি করেছেন?’গণমাধ্যমকে অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে ফখরুল ইসলাম বলেন, নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়কে যখন আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন ও বিএনপিকে দুর্বল করার অসৎ উদ্দেশ্য বলছি, তখন সেই রায়ের ভিত্তিতে আমাদের নেতা তারেক রহমানের পদত্যাগের প্রশ্ন আসে না।

আমরা আশা করি, ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ক্ষমতাবান কারও তুষ্টির জন্য কারও বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো থেকে দায়িত্বশীল মিডিয়া বিরত থাকবে।মির্জা ফখরুল বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি এ দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালাতে থাকে। পরাজিত শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে রোধ করে। জাতির পিতাকে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে না গিয়ে বহমান থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন চেষ্টা চালানো হয়।আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আদালতের এসব পর্যবেক্ষণ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বক্তব্য হুবহু এক। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, জেলখানায় চার জাতীয় নেতার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ঘৃণ্য অপরাধকে একসূত্রে গাঁথার যুক্তি সঠিক হলে, বিএনপি কিংবা বিএনপি পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপরাধী বলা হলো কোন যুক্তিতে? তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে বিএনপির জন্মও হয়নি এবং ১৫ আগস্ট বা ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের বিচারে কোনো আদালতই বিএনপি কিংবা বিএনপির কোনো নেতাকে অভিযুক্ত, এমনকি সম্পৃক্তও করেনি।মির্জা ফখরুল প্রশ্ন করেন, তাহলে ২১ আগস্টের ঘটনার বিচারের পর্যবেক্ষণে আগের দুটি ঘটনার উল্লেখ কতটা প্রাসঙ্গিক? দল বিশেষের রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণ মিলে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয় বলেই জনগণ মনে করে।

আদালতের পর্যবেক্ষণ বিষয় ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, আদালতের পর্যবেক্ষণে বিরোধী দলের প্রতি সরকার ও সরকারি দলের প্রত্যাশিত আচরণ সম্পর্কে যেসব বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে-তা বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারি দলের আচরণের ঠিক বিপরীত। আমরা আশা করব সরকার আদালতের এসব পর্যবেক্ষণ মান্য করবে। তিনি বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ থাকলেও বিচারকের বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি সরকারি দলের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে দেওয়া পর্যবেক্ষণে বর্তমান সরকারের আমলে সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ, সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ও সাইফুল ইসলাম, কাউন্সিলর চৌধুরী আলম, ছাত্রনেতা জাকিরসহ গুম হওয়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কোনো কথা নেই কেন, জনগণ তা জানতে চাইতেই পারে।বিএনপির মহাসচিব বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে কাঙ্খিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে গত ১০ বছরে হাজারো গুম, খুন, গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে পঙ্গু করা, হাজার হাজার গায়েবি মামলা দিয়ে লাখ লাখ বিএনপি নেতা-কর্মীদের বছরের পর বছর ঘরছাড়া করে রাখা, গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করার বিষয়ে কোনো কথা না থাকা রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পারে।

সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ফখরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে সংঘটিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের শাসনামলে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, হলি আর্টিজানে হত্যাকাণ্ড এবং জঙ্গি হামলায় নিহত বিদেশি কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইমাম-মোয়াজ্জিন, যাজক, পুরোহিত, ব্লগারসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডের দায় ক্ষমতাসীনদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।মুফতি হান্নানের জবানবন্দির বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মুফতি হান্নানের বেআইনি দ্বিতীয় জবানবন্দি বাদ দিলে তারেক রহমান এবং অন্য অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিকেই এই মামলায় অভিযুক্ত করা যেত না। যৌক্তিক কারণেই এ কথা বলা যায় যে, প্রকাশ্য আদালতে মুফতি হান্নানকে দিয়ে জোর করে জবানবন্দিতে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে-এটা যেন বলতে না পারেন, সে জন্যই অন্য একটি মামলায় দ্রুততার সঙ্গে তার ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কোনো উল্লেখ না থাকাও বিস্ময়কর এবং সন্দেহমূলক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।