বদলে যাচ্ছে একশত বছরের পুরনো ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার ঢালচর। দশ কিলোমিটার দীর্ঘ আর চার কিলোমিটার প্রসস্ত এই দ্বীপ চরে আশার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। পৈতৃক ভাবে প্রাপ্ত শতশত বিঘা জমি। এক ফসলি এই জমি, আর মহিষের বাতান, এই নিয়ে এই চরের মানুষের জীবন। বাড়তি আয় মেঘানায় মাছ ধরা। ঝড় ঝঞ্জা জলোচ্ছ্বাস, কঠিন জীবন এই অঞ্চলের মানুষের। মনপুরা উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ৩০ মিনিটের দুরত্বের এই চরে এখনও মানুষ বাস করে আদিম যুগে।

বিদ্যুৎ নেই, চিকিৎসা নেই, পানিও জলের ব্যবস্থা নেই, স্কুল নেই, যাতায়াতের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, ডাক্তার নেই, এক অনিশ্চয়তার জীবন নিয়ে চারটা ডাল ভাত জোগারের তাগিদে এই এলাকায় বসবাস করছে মানুষ। চারদিকে মেঘনা নদী।
চরের দুই দিকে পাহাড়ায় চীনের প্রচীরের মত দাড়িয়ে ঘন সবুজ বন। শত প্রজাতির পাখী মায়ময় হরিন, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বানর, কাঠবিড়ালী শীতে সাইবেরিয়া পাড়ি দিয়ে আসা মৌসূমী অতিথি পাখির কলতান। মায়াময় অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই দ্বীপ কে বদলে দেবার, মানুষের বসবাস আর কর্মসংস্থানের লক্ষ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন এই এলাকার কৃতি সন্তান সরকারের অতিরিক্ত সচিব জনাব নাজিমুদ্দিন চৌধুরী।

এব্যাপারে নাজিমুদ্দিন চৌধুরী বলেন, মনপুরার মাটি আর মানুষের কাছে আমি এবং আমার পরিবারের ঋণ রয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষ এখানে এসে বসবাস শুরু করে। আমার দাদা আবুল ফাতাহ্ চৌধুরী আমার বাবা ও কাকাদের ভোলা এবং বরিশালে পড়ালেখা করান। সেই সূত্রে আমার বাবা বরিশালে ও ভোলাতে বাড়ী করে আমাদের নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। আমার বড় হওয়া, বেড়ে উঠা। পড়া লেখা বরিশাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রতি বছর ধান কাটার মৌসূমে মনপুরায় যেতাম, শীতেও যেতাম পাখি শিকার করতে। মানুষের মমতা ভালবাসা আমাদের পরিবারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আমাকে তাগিদ দেয় এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কিছু করার। নাজিমুদ্দিন চৌধুরীর বাবা বরসাত উল্লাহ্ চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান আমলে তিনি ছিলেন ওয়াপদার একজন শীর্ষস্থানীয় ঠিকাদার। মুক্তি যুদ্ধের শুরুতে তিনি সাতক্ষিরায় একটি কাজের বিল পান, এবং ঐ সমুদয় টাকা এবং তার ব্যবহৃত জীপ নিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে যান।

বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে টাকা প্রদান:-
টাকার পুরোটাই তিনি ত্যকালীন ভোলার জাতীয় পরিষদ সদস্য উনসত্তরের গনঅভ্যুত্থানের মহানায়ক মুজিব বাহীনির প্রবক্তাদের একজন তোফায়েল আহমেদর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকারী তহবিলে দান করেন এবং তার জীপ এবং ড্রাইভার মোনায়েম, মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দদের কাজে ব্যবহার হত। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি।
নাজিম উদ্দিন চৌধুরী পড়া লেখা শেষে প্রথমে ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরিবর্তিকালে অডিট ও একাউন্টনসে জয়েন করেন এবং সর্ব শেষে প্রশাসনে বর্তমানে তিনি জালানী এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ে অতিরিক্ত সচিব এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানীর চেয়ারম্যান। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশনের বর্তমানে সভাপতি’র দায়িত্ব পালন করছেন।

কি করা যায় এ চরাঞ্চলে:-
কর্ম সূত্রে পৃখিবীর বহু দেশ ঘুরে নানা কিছু দেখার সুযোগ হয় তার। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চান চৌধুরী। এখানে তাই তিনি বেশ কয়েক বছর আগ থেকে শুরু করেন একটু একটু করে তার স্বপ্নের বীজ বোনা। এখন তিনি তার চুড়ান্ত পর্বে হাত দিয়েছেন। তার চাকরির ভবিষৎ তহবিল থেকে লোন নিয়ে তিনি এখানে গড়ে তুলছেন ৪০ একর জায়গায় আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত মৎস চাষ প্রকল্প। ৫টা ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ইতিমধ্যে তিনি তার প্রজেক্টের কাজ সম্পন্ন করেছেন। চলছে সোলার প্যানেল দিয়ে পানি তোলার ব্যবস্থা করা এবং আরও ৩৮ টি সোলার দিয়ে সম্পুর্ণ প্রজেক্টকে আলোকিত করার কাজ। ব্যায়োগ্যাস প্লান্ট বসানোর কাজ আগেই শেষ হয়েছে। প্রাথমিক প্রস্তুতিতে ছিলো ৪টি পুকুর। যাতে পূর্ব থেকে মাছ চাষের অভিজ্ঞতা নেয়া যায়। আছে তার ১শ’ মহিশ, ১শ’ গরু, ১শ’ ছাগল, ১শ’ ভেড়া, ১শ’ হাঁস, ১শ’ মুরগী। এই সমস্তই তার পরিকল্পনার পূর্ব প্রস্তুতি। এখন তার স্বপ্ন ছুয়ে দিচ্ছে এলাকার মানুষকেও।

পরিকল্পনা:-
অনগ্রসর এই এলাকায় তিনি এখান কার মানুষদের সম্পীক্ত করে ঢালচর উন্নয়ন কমিটি গঠন, শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, প্রথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, যাতায়াতের জন্য রাস্তা এবং নদী পারাপার ও মালামাল পরিবহনের জন্য ইতিমধ্যেই তিনি চট্রগ্রাম থেকে জাহাজের একটি রেসকিউ বোট সংগ্রহ করেছেন। ১শ’ ২০ (এইচপি)’র এই বোটে যে কোন দুর্যোগে মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারবে দ্রুত। তার কাজের প্রেরণায় আরো ২টি প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছেন এই এলাকার চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন। নাজিমুদ্দিন চৌধুরীর ফুফাত ভাই সেলিম চৌধুরী ও শুরু করবেন একটির কাজ। সব মিলিয়ে ঢালচরে এক নতুন স্বপ্নের দীগন্ত উন্মোচীত হবে এমনই ধারনা এই এলাকার মানুষের। চৌধুরীর স্বপ্ন আরো বড়, তিনি বলেন মাটির প্রতি অনুগত হতে না পারলে দেশের প্রতি ভালবাসা জন্মায় না। আমি জানিনা; কতটা কি করতে পারব। আমার যোগ্যতা আর সামর্থ দিয়ে আমি আমার এলাকার একটি চরকে মডেল হিসাবে দার করাতে চেষ্টা করছি। তা থেকে অনুপ্রেরনা নিয়ে আমার মত কেউ তার এলাকায় এগিয়ে আসলে আমার স্বপ্ন চেষ্টা সার্থক হবে।

ঢালচরের মহিষের এবং গবাদি পশুর দুধ ও মাংস এবং এর প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটকদের আকর্ষণের স্থান হতে পারে। উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে যে মালদ্বীপ তাদের ছোট ছোট দ্বীপগুলিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। যেমন সিঙ্গাপুর তাদের বিকাশ ঘটিয়েছে আমাদের দেশেও আছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। শুধু চাই সমন্বীত পরিকল্পনা আর দেশ প্রেম। তাহলেই ভোলার মনপুরা উপজেলার ঢালচর তথা দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।