ভালোবাসার খুঁটির পর গড়ি সুখি পরিবার। পুরো বিশ্বভাণ্ডারের শিক্ষাকে আর কতোদিন শ্রেণিকক্ষে, লাইব্রেরিতে বা গ্রন্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে হবে? কখন আমরা স্বপ্নের রাজ্য থেকে বাস্তবের রাজ্যে আসতে সক্ষম হবো? কবে আমরা পুঁথিগত বিদ্যাকে সুশিক্ষায় রূপান্তরিত করতে পারব? সময় এসেছে পুঁথিগত শিক্ষা ও দৈনন্দিন বাস্তব জীনের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে সুশিক্ষা অর্জন করা এবং সেটাকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করার কাজটি শুরু করা। আর এ কাজটি শুরু হোক শিশুর জন্মের শুরুতে, কারণ দেশে শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই, অভাব সুশিক্ষিত মানুষের! মানবতা, দায়িত্বশীলতা, পরিশ্রম এবং দেশপ্রেম এই শিক্ষাগুলো শুধু পরীক্ষার খাতায় নয়, মনের পাতায় লিখি, একই সাথে সুখের জন্যে তৈরি করি মানুষের সাথে মনুষ্যত্বের ভালোবাসার সেতু, কিন্তু কী করে পেতে পারি এই সুখ! সুখ তুমি কোথায়? আমরা তো তোমার সন্ধানে? আমরা সবাই তো সুখি হতে চাই। আর তার জন্য এত কষ্ট, এত ত্যাগ। কিন্তু তারপরও কেউ সুখি হই কেও হই না। অনেকে জীবনের বন্ধনে, সুখের সন্ধানে ছুটে চলেছে দেশ বিদেশে। পাগলের মতো খাঁটছে দিনরাত শুধু সুখের জন্য। সুখের দেখা খুব একটা মিলছে না। আবার কেউ যে সাধারণ জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে সত্যিকারে সুখে আছে, কিন্তু সে তা জানে না।

আজ তুলে ধরবো তিনজন ভিন্ন মানুষের জীবনকাহিনী, এরা কেউ কাউকে চেনে না। এরা জীবনযাপন করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এদের তিনজনকেই আমি মোটামুটি চিনি। বন্ধু মেহেদি জন্মগত সুত্রে ইরানি, বাস করছে অামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সানসেট বুলেভার্ডে, তার সব কিছু আছে, শুধু নেই স্ত্রী। জীবনে সে একা, শুধু একা। তার ভাষাতে সে বলে “অলওয়েজ অ্যালোন, নেভার অ্যালোন” মানে কাজে বা সমাজের সব কর্মে সে একা নয় কারণ তার চারপাশ জুড়ে রয়েছে অনেক লোক, তবে বাড়িতে সে একা। মনে তার শান্তি নেই। অথচ সে অামেরিকার এক হাজার ধনিদের মধ্যে একজন। তার বর্ণনায় সে সুখি নয় তবে সে সুখি হতে চায়। স্টকহোমের বন্ধু জোহান, সুইডেনের এক হাজার বড় লোকদের মধ্যে সেও একজন, পরিবারে বউ সহ দুই ছেলে, দু’জনই বাড়ি ছেড়ে নিজেদের দায়িত্বে জীবনযাপন করছে। জোহানের বউ পেশায় মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর। বন্ধু নিজেও সুইডেনের নামকরা অর্থোপেডিক এবং এখানের এক বড় হাসপাতালের অর্থোপেডি বিভাগের দায়িত্বে। পনেরো বছর ধরে ওঠা বসা তার সাথে, হঠাৎ জানালো সে জীবনে সুখি না তাই কিছুদিন আগে নতুন করে অন্য এক সঙ্গিনী নিয়ে জীবন যাপন শুরু করেছে। আজ জানলো সঙ্গিনীর অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে যা জোহান জানতে পেরেছে, এখন বন্ধু জোহান নতুন করে সুখের সন্ধানে। এরা সমাজের দায়িত্ববান। এরা সমাজের জন্য যা করার করছে। এদের বাবা-মা বড়লোক। এদের পিছে কোন বার্ডেন নেই। এদের জীবনের শেষে এদের রিটায়ারমেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে, এদের সব থাকতেও কিছু নেই। এরা মনে করছে এরা জীবনে সুখি নয়।

এদিকে বাংলাদেশের এই ছেলে ছোটখাঁটো চাকরি করে, পরিবারের লোকসংখ্যা বর্তমান তেরোজন। এদের মধ্যে রয়েছে এর বাবা-মা, দুই ভাই এবং তাদের বউ, সঙ্গে তাদের ছোট তিনটি বাচ্চাসহ নিজের ছোট্ট দুটি বাচ্চা ও তার স্ত্রী। সংসারে বাচ্চারা পড়াশুনো করে, বাকি সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। বাবা-মা বৃদ্ধ বিধায় তাঁরা কৃষিকাজ ছেড়ে বাড়িতে ছেলেদের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করছেন। তারপরও বাংলার এই পরিবার সুখের সাথে একত্রে বসবাস করছে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। যদিও এই পরিবারে এসেছে তিনজন ভিন্ন পরিবারের তিনটি মেয়ে, বউ হয়ে। এরা বাংলাদেশের একটি অতি সাধারণ পরিবার। আমার কাছে এরা হচ্ছে জাস্ট সোনার বাংলার প্রতিচ্ছবি, যেখানে সুখে, দুঃখে সবাই এক সঙ্গে বসবাস করেছ। আমি জানাই আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এই পরিবারকে, সাথে শেয়ার করতে চাই আনন্দের সঙ্গে এমন একটি বিরল কাহিনী যা আমার “ওয়াক এজ ইউ টক” কনসেপ্টের মধ্যে বিরাজ করছে। ছেলেটির নাম শাহজাহান মিয়া। ওদের বাড়ি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের বেজড়া গ্রামে। আজ আমি এই আদর্শ পরিবারটিকে তুলে ধরার সঙ্গে, আমার ভাবনা থেকে কিছু কথা তুলে ধরবো, তা হোল—যারা চাকরি করে, তারা চাকরি জীবনশেষে পেনশন পায় কিন্তু যারা সারাজীবন কৃষিকাজ করে তাদেরও তো একটি সময় আসবে জীবনে যখন তারা বৃদ্ধ হবে। এদের কোনো ভাতা বা পেনশনের কোন ব্যবস্থা নেই। এদের একমাত্র আশা-ভরসা, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যদি ভালো কিছু করতে পারে তবে তারা দেখাশুনা করবে। এরা না পায় কোন বৃদ্ধভাতা, না পায় পেনশন। তখন এদের একমাত্র ভরসা এদের সন্তানেরা। সোনার বাংলায় সুসন্তানই সাধারণত বাবা-মার পেনশন, তাই কৃষকবাবা ফসল উৎপাদনের সাথে উৎপাদন করে চলেছে যুগে যুগে দৈনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সুশিক্ষিত সুসন্তান, যে বা যারা হয়ে থাকে পিতামাতার উপযুক্ত পেনশনব্যবস্থা, জীবনের শেষ সময়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তানেরা বাবা-মার সঠিক বা আদৌ খোঁজখবর রাখে না, যা হতে পারে মানবতার অবক্ষয় বা দরিদ্রতার কারণে। সোনার বাংলার আসল পরিচয় কৃষিক্ষেত্র। এখন এই কৃষকদের শেষজীবন যদি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটি হয় যে তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল, তাহলে কি মনে হয় যে নতুন প্রজন্ম ধরে রাখবে এই কৃষিকাজ? সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার! এখন কেন আমি শাহজাহানের পরিবারকে একটি মডেল পরিবার বলতে চাই? খবরের কাগজ পড়তেই চোখে পড়ে বাবা-মার ভালো শিক্ষিত বা চাকুরিজীবী ছেলেমেয়ে থাকা সত্বেও বাবা-মা ভিক্ষা করছে বা বৃদ্ধাশ্রমে ঢুকেছে। এই ছেলে কিন্তু ব্যতিক্রম? সে পেশায় একজন ব্যাংকার। বাংলার অতি সাধারণ পরিবার থেকে স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে এবং তার স্ত্রীও ইডেন থেকে এমএসসি সম্পন্ন করে প্রথম শ্রেণি পায়। সে ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত বলেই সে তার মানবতা ও আদর্শেকে ধরে রেখেছে অসাধারণভাবে, যা আজকের যুগে বিরল, শুধু বাংলাদেশে নয় পুরোবিশ্বে। স্বাধীনতা অর্জন করা থেকে স্বাধীনতা ধরে রাখা কঠিন কাজ, ঠিক তেমনিভাবে বলতে চাই, রোল মডেল তৈরি করার চেয়ে তাকে ধরে রাখা এবং তা মেইনটেনেন্স করার মত মহানুভবতা কতোজনের মধ্যে আছে এ যুগে? কতোজন আছে তা জানিনে তবে শাহজাহান এমনটি রোলমডেল হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশে যা আমাকে মুগ্ধ করছে। শাহজাহানের পরিবারের একান্নভুক্ত সুখি পরিবেশ এবং তারা সপরিবারে গ্রামে থেকেও দৈনিক শিক্ষার সমন্বয়ে পেয়েছে সুশিক্ষা যা আমাদের জন্য সত্যি শিক্ষামূলক। ঘুরেছি বিশ্ব দেখেছি জ্ঞাতি, তুমি কি তাহলে মানবজাতি? সুখের জন্য ভুলেছি আমরা স্বজন, তুমি রেখেছ ধরে তোমার আপনজন। তোমার মতো আরো পরিবার আসুক বারবার, তুমিই সোনার বাংলার সুখি পরিবার।

আমি রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে।