কিন্ডারগার্টেন থেকেই শুরু করতে হবে সুশিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ, তা না হলে বয়ঃসন্ধির আবির্ভাবের সঙ্গে দৈনন্দিন কাজকর্মের ফল মনের মধ্যে ভালোমন্দের কনফ্লিক্টের সমন্বয় ঘটাবে, যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে জীবনের বাকি সময়ে। শিশুর অনুকরণ ও অনুসরণ করার ক্যাপাবিলিটি সবচেয়ে বেশি শৈশবে এবং বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত সময়। তাই স্কুলে নয় কিন্ডারগার্টেন থেকেই শিশুকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে শুরু করতে হবে সুশিক্ষার ওপর বেস্ট প্রাকটিসের মধ্য দিয়ে। তা না হলে সমাজে দিন দিন বাড়তে থাকবে ব্যস্ততা, ব্যর্থতা, পরশ্রীকাতরতা এবং স্বার্থপরতা, যা জন্মের শুরুতে না হলেও বিবেক যখন বেশ তাড়া দেবে ঠিক তখন থেকেই মানুষের ভেতর পরশ্রীকাতরতা, স্বার্থপরতা ও ব্যস্ততার প্রবণতা দেখা দেবে। “আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি, যখন কেউ কিছু বলতে চায় আমি আকারে ইঙ্গিতে বলে দেই আমার সময় নেই, তবুও তাদের কিছু বলতে সময় দেই বটে, তবে শোনার সময় নেই কারণ আমি অন্যমনস্ক। আমার অনেক কাজ, আমার অনেক দায়িত্ব, আমি ছাড়া তো কিছুই ঠিকমতো হয় না, হবেও না। এদিকে আমার কত কাজ আমি ব্যস্ত মানুষ”। এই হল একজন ব্যস্ত, ব্যর্থ,পরশ্রীকাতর এবং সেলফিস মানুষের পরিচয়, যে শুধু নিজেকেই বড় মনে করে এবং অন্যের ভুলত্রুটির ওপর সারাক্ষণ লেগে থেকে তাকে নিচে রাখতে চেষ্টা করে। সমাজে এ ধরণের লোকের অভাব নেই, তারপরও দিন দিন এদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, সুশিক্ষার অভাবে। কথা হবে আজ এদের নিয়ে যা আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে লক্ষ করেছি। আসুন জানি কিছু বাস্তব উদাহরণ থেকে। শুধু বাংলাদেশে নয় এ অভিজ্ঞতা আমার বিদেশেও হয়েছে। কিছু কলিগের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কীভাবে তারা ছোট করতে চেষ্টা করেছে, মিটিং-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার মাঝে হয়তো ভাষাগত ত্রুটি হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে ভুলটা ধরে সবার সামনে ছোট করতে দ্বিধাবোধ করেনি বা কিছু জিজ্ঞেস করতেই বলেছে আমি খুব ব্যস্ত, আমার অ্যাজেন্ডা দেখতে হবে।

বাংলাদেশের অনেক পরিচিত বন্ধুকে ফোন করতেই তারা ভীষণ ব্যস্ত। যেহেতু সবাই ভীষণ ব্যস্ত তাই আমি আবার টেক্সট করে জেনে নেই যে তাদের সময় হবে কি কথা বলার বা তারা সময় করে যেন কল ব্যাক করে। একজন হঠাৎ ফোন করতেই শুরু হল তার ব্যস্ততার উপর নানা কথা, এর মধ্যে তার আরেকটা ফোন বেজে উঠতেই আমাকে আটকে রেখে তার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এক্সকিউজের সঙ্গে সে যে কত ব্যস্ত সেটাই প্রমাণ করলো। আরেকজন দিব্বি ফোন করে আর প্রায়ই নানা ধরণের ফালতু কথা বলতে পছন্দ করে, তবে কাজের কথা এলেই সে ভীষণ ব্যস্ত, শুধু কি তাই সে ছাড়া তো সব কিছু অকেজ! তার বাড়ির বউ থেকে শুরু করে অফিসের কলিগরা এমনকি বন্ধুরা পর্যন্ত গাঁধা! কেও কিচ্ছু জানে না বা বোঝে না, তার কথায়। আমার ভাবনা থেকে কিছু কথা। প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলেছে জীবনে এত ব্যস্ত কখনও ছিলাম না বা এখনও ব্যস্ত নই। হ্যাঁ চাকরি থেকে শুরু করে রান্না করা, ক্লিন করা, ডিশিং-ওয়াশিং করা, থালাবাটি পরিষ্কার করা, বাজার করা, গাড়ি চালান, ছেলে-মেয়েকে সব ধরণের সাহায্য করা, সামাজিকতা করা, দেশ-বিদেশ ঘোরা, আড্ডা মারা, বিনোদন করা, এমনকি লেখালেখি করা সবই কিন্তু চলছে, তারপরও ব্যস্ত বা খুব ব্যস্ত এ কথা মাথায় আসেনি জীবনে, যা চারিপাশে শুধু শুনছি আর ভাবছি! যারা সারাক্ষণ ব্যস্ত বলে দাবি করছে দেশে-বিদেশে তারা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এবং কোনোভাবেই আমার থেকে ভালো নেই যা আমি বেশ লক্ষও করেছি। তাহলে কী কারণ থাকতে পারে এই ব্যস্ততার পিছনে? কারণ একটাই তাহল এ এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা। যারা জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে ব্যর্থ হয়েছে বা মেনে নিতে শেখেনি পরাজয়, সহজ সরল পথ ও উদারতা, তারা নিজেদের চারিপাশে স্বার্থপরতা ও ব্যস্ততার জাল বুনে নিজেকে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছে মাত্র। বেশির ভাগ মানবজাতির ধারণা যে “আমি ছাড়া কিছুই ঠিক মতো হবে না, বা কেউ ম্যানেজ করতে পারবে না। আমার থেকে ভালো কেউ পারবে না বা বুঝবে না এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মাও মনে করেন কী হবে ছেলে-মেয়ের যদি আমি বা আমরা না থাকি তাদের পাশে, ইত্যাদি ইত্যাদি”।

আসুন এবার পুরনো ইতিহাসের কিছু সত্য তুলে ধরি। যিশুর জন্মে বাবা ছিলো না, মায়ের সাহায্যে তিনি বড় হয়ে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর নেতা হয়ে আছেন। ইসলাম ধর্মে হযরত মুহম্মদ সঃ-এর জীবনের শুরুতেই বাবা-মা ছাড়াই তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং বিশ্ব নবী ও রাসুল হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বলতে পারি “What is lotted, cannot be blotted”. তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, যারা সমাজে যত বেশি ব্যস্ত বলে দাবি করছে তাদের কনট্রিবিউশন ততো কম পরিবারের, সমাজের এবং দেশের প্রতি, কারণ এ ধরণের লোকেরা অন্যকে বিশ্বাস করে না, এরা সবসময় অন্যের জ্ঞানকে লো-প্রোফাইল বলে গণ্য করে। এদের ব্যাড ম্যানেজমেন্টের কারণে এদের কোন ফলোয়ার থাকে না। এদের সংস্পর্শে যারা জড়িত তাদের নতুন কিছু জানা বা শেখার সমন্বয়ও ঘটে না। এরা মানুষকে নিচু করতে পারদর্শী। এরা পরিবারের, সমাজের এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর এবং এরা অসুস্থ। মানুষ জাতির সবচেয়ে বড় পরিচয় কী? নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস এবং সেই আত্মবিশ্বাস যখন না থাকে তখন এ ধরণের লোক মানসিক অসুস্থতার কারণে এমনটি আচরণ করতে শুরু করে, যা দিন দিন সমাজের অন্য লোকের জীবনে নেগেটিভ প্রভাব বিস্তার করে, কারণ এদের ধ্যানে ও জ্ঞানে এরা অন্যকে সব সময় নিচু করে, কথায় এবং কাজে। সর্বশেষে এদের আশেপাশে যারা বাস করে তারাও তাদের আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকে। পরিবারের ক্ষেত্রেও কিন্তু এমনটি ঘটে, তখন ছোটরা ভয়ে কিছু বলতে সাহস হারিয়ে ফেলে, কারণ তারা মনে করে যে তারা সত্যি বোকা, গাধা, ভ্যালুলেস, ইউজলেস ইত্যাদি ইত্যাদি।

শুধু পুঁথিগত বিদ্যা হলেই কি সুশিক্ষিত ও আদর্শ মানুষ হওয়া সম্ভব? না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে ইউনিক কোয়ালিটি, যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত পরিচয়। এখন যদি এসব পণ্ডিত এবং ব্যস্ত লোক সারাক্ষণ আঘাত করে কারো দুর্বলতার ওপর, তখন তারা হারাতে থাকে নিজেদের কনফিডেন্স এবং শেষে এরাও নিজেদেরকে ব্যস্ত মানুষ বলে সমাজে বসবাস করতে শুরু করে। সময় এসেছে এর সমাধানের। জানা দরকার ব্যস্ততার কারণ কী? আমি ছাড়া আর কি কেউ নেই, যে এ কাজটি করতে পারে? কে করবে সেদিন, যেদিন আমি হঠাৎ অসুস্থ হবো বা মারা যাবো? প্রায়োরিটি দিতে শিখতে হবে যে সব কাজই গুরত্বপূর্ণ নয় বা গুরুত্বপূর্ণ সত্বেও যদি তা না করি, কী হবে? জীবনে রিস্ক নেওয়া শিখতে হবে। মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? গেলে যাক না? ম্যানেজমেন্ট বাই থ্রেট নয়, ম্যানেজমেন্ট বাই অবজেকটিভসের সমন্বয়ে সকলকে কাজে জড়িত করা, তাদেরকে বিশ্বাস করা, উৎসাহিত করা এবং সর্বোপরি নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখা সঙ্গে অন্যকে বিশ্বাস করা শিখতে হবে। সমাধান খুঁজে বের করতে হবে এর থেকে রেহাই পেতে হলে কী করা যেতে পারে? অবশ্যই এর সমাধান রয়েছে এবং তা হলো মনের কলুষতা দূর করা এবং নিজেকে জানা, সাথে দুটো রুলস তৈরি করা। রুলস নাম্বার ওয়ান, সুশিক্ষার সমন্বয়ে নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। রুলস নাম্বার টু, “ডোন্ট ফরগেট রুলস নাম্বার ওয়ান”। আমি ভালবাসি মানুষকে তুমি ভালবাসো আমাকে, এমনটি প্রত্যাশায় প্রত্যাশিত।

রহমান মৃধা, পরিচালক ও পরামর্শক দূরপরবাস সুইডেন থেকে।