আমার বড় কাকা ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক।গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোথাও জাননি, কৃষি কাজ এবং শিক্ষকতা ছিলো তাঁর পেশা। অন্যদিকে আমার বাবা তখন সরকারি চাকরির কারণে ভারতবর্ষের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সহ তৎকালীন ১৭ জেলার ভাত খেয়ে বেড়াচ্ছেন। বেশ ছোট্ট তখন, তবে কিছু কিছু স্মরণীয় ঘটনা যা মনে গেঁথে আছে, তা আজো ভুলিনি। বৃটিশের পতন ঘটেছে, পাকিস্তানের আগমনে স্বাবাভিক ভাবেই বাঙ্গালীরা স্বাধীনতার কিছুটা ভাব উপলভদ্ধি করতে শুরু করেছে। আমার জন্মে টেলিভিশনের কথা শুনেছি বলে মনে হয় না তবে রেডিও ছিল বিনোদনের এক বিস্ময়কর আবির্ভাব তখনকার দিনে। আয়ুব খাঁন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রসিডেন্ট, মাঝে মধ্যে রেডিওতে ভাষণ দিত আর পুরো পুর্ব পাকিস্থানে খবর হয়ে যেত। ১৯৬৫ সালের কথা, আমার বড় কাকা বাড়ির কাজের লোকদের দুপুরে গমের রুটি খেতে দিয়েছেন, কাজের লোকেরা রুটি খেতে নারাজ, হঠাৎ শুনতে পাই বড় কাকা জোরে জোরে চিৎকার করে বলছেন “মোদের রাজা আয়ুব খাঁন তিনি গমের রুটি খান, তোমরা কেন খাবে না”? কাজের লোকগুলো ফরিদপুর থেকে এসেছে তাদেরকে দিব্বি পরিদপুরের বাঙ্গালী বলে আক্ষায়িত করা হয়েছে তখন, ঝগড়ার এক পর্যায়ে তারাও কাকাকে বলে ফেললো যে আমরা বাঙ্গালী আর আপনি কি তাহলে পানজাবী? কাজের লোকেরা বললো রুটি খাবো না, তিন বেলা ভাত চাই নয়লে “জাবো গা”! গমের রুটি আমি নিজেও দেশে থাকতে খেতাম না, খেলেও তা হতে হবে চালের রুটি বা গমের আটাকে ভালো করে এক্সট্রা ভাবে চালনা দিয়ে চেলে, গমের খোসা বের করে অনেকটা ময়দার আটার মত করে যদি মা পরাটা করতেন তবে খেয়েছি, নয়লে নয়।

দেশে থাকতে সিলেকটিভ খাবার খাওয়া ছিলো আমার অভ্যাস এবং মা জানতেন আমার কি পছন্দ বা কী খেতে অভ্যস্ত। আজ এত বছর পরও চেষ্টা অব্যহত রয়েছে বাংলাদেশী খাবারের আমার সুইডেনের বাড়িত। ছোটো বেলাতে যে সব খাবারের সাথে আমি বেশি পরিচিত সে সব খাবার আমি চেষ্টা করি রান্না করে খেতে যার কারণে মাঝে মধ্যে লন্ডন থেকে সেসব খাবার আনা, আমার এটা স্বভাবের মধ্যে পড়েছে। সুইডিসরা ভালো করে জানে আমি বাংলা খাবার বেশি পছন্দ করি এবং রান্না করতে পারি যা আমি শিখেছি আমার ছাত্রজীবনে। মজার ব্যপার হচ্ছে ছোটবেলাতে যেভাবে সব ধরণের খাবার যেমন, শাখ-সব্জি থেকে শুরু করে চাল, ডাল বা ফল বাংলাদেশে দেখেছি তা এখন দিব্বি দেখতে পাচ্ছি পাশ্চাত্যে এবং শুধু তাই কি? ইটালিতে বাংলাদেশীরা রিতিমত উৎপাদন করতে শুরু করেছে বাংলদেশের সব ধরণের ফল-মুল যা দেখলে অবাক হবারই কথা। মানব জাতির গ্লোবালাইজেশনের কারণে বিশ্বের সর্বস্তরের ফল-মুল থেকে শুরু করে শাঁখ সব্জি পর্যন্ত এখন আমদানি এবং রফতানি হতে শুরু করছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যার কারণে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এবং রয়েছে পছন্দের মত খাবার থেকে শুরু করে পোশাক-আশাকেরও, যা অতিতে ছিল কল্পনা মাত্র। মানুষ এখন নানা ধরণের খাবারে অভ্যস্ত যার ফলে যেটা তাদের পছোন্দের সেটাই তারা কিনতে পারছে এবং সবকিছু সর্বত্রে বিরাজমান বর্তমান যুগে।

খেলাধুলোর জগতে, বিনোদনের জগতে এমনকি সাধারণ মানুষের জগতে মানুষ জাতি বেছে নিতে শুরু করেছে হঠাৎ করে নিরামিষ খাবার। এখানে নিরামিষ বলতে বলা হয় , ভেজিটেরিয়ান এবং ভ্গােন। ভেজিটেরিয়ান হতে পারে কয়েক প্রকার। কেও মনে করছে ‘রেডমিট’ ছাড়া আর সব খেতে অসুবিধে নেই। কেও আবার কোনো ধরণের ‘মিটই’ খাচ্ছে না। কেও শুধু মাছ এবং সব্জি খেতে পছন্দ করছে, কেও সব ধরণের ‘বিনস’ বা ডাল খেতে পছন্দ করছে, ডাল আবার রয়েছে অনেক প্রকার। কিছু লোক ডিম খাওয়া ছেড়েছে। এখন শুরু হয়েছে ১০০% ভেজিটেরিয়ান যেখানে কোনো রকম এ্যনিম্যাল ফ্যাট নেই এবং ইকোলজিকাল পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে হবে, যাকে বলা হয় ভ্গােন। সব যাইগাতে ভেগান খাবার পাওয়া দুঃস্কর হয়ে পড়েছে, তার পর ভ্গােন খাবারের দাম দ্বিগুন। আমার পরিবারে আমার বউ প্রথম থেকেই মাছ এবং সব্জি বেশি পছন্দ করতো, ছেলে-মেয়ে দিন দিন ভ্গােনের দিকে কারণ খেলাধুলোর জগতে শরীরের পুরো শক্তি যাতেকরে খেলাধুলোয় ব্যয় হয়। হেবি খাবার যেমন গোশ এরা এভোয়েট করে চলছে। হেবি খাবারকে শরীরের কাজে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রচুর পরিমান এনার্জি ব্যয় করতে হয় শরীরের জন্য, যা সহজ ওপায়ে কোম এনার্জি ব্যয়ে পাওয়া সম্ভব ভ্গােন খাবার থেকে, একই সাথে ইকোলজিকাল পদ্ধতিতে উৎপাদন।( যেসব শাঁক-সব্জি, ফল-মুল মাছ-মাংস সাধারণ ভাবে উৎপাদন করা হয় কোনো প্রকার ক্যমিক্যাল ছাড়া তাকে ইকোলজিকাল ফুড বলা হয়, যা আমার জীবনের শুরুতে বাংলাদেশে দেখেছি)।

এখন কেন আজ হঠাৎ এসব কথা ? কারণ একটাই তা হোল সোনার বাংলার মাটিতে যা ফলাই তাই ফলে এবং এর উর্ভর শক্তি এত বেশি যে, যেকোনো ফসল ফলাই না কেনো এর মধ্যে রয়েছে সব ধরণের প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল যা আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। গমের খোসা যা জীবনে ভাবতে পারিনি যে খেতে হবে, তা দিয়ে তৈরি করছে পাশ্চাত্যে ‘হার্ড ব্রেড’। এবং এই হার্ড ব্রেড পেটের জন্য খুবই উপকারী। মসনে, যা হতে তেল উৎপাদন করা হয়, তা ব্যবহার করা হচ্ছে যাদের পায়খানার সমশ্যা তাগেপ চিকিৎসার জন্য। এই আস্ত মসনে হাসপাতালে রোগীকে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়নো হচ্ছে। বেশির ভাগ ডাল খোসা সহ রান্না করা হচ্ছে এবং এসব ‘বিনস’ বা ডাল দোকানে কিনতে গেলে দেখা যাচ্ছে তার দাম দ্বিগুন তুলনামূলক ভাবে। চাউলের ক্ষেত্রে ঢেকি ছাঁটা চাউল এবং রেড কালারের রং যাকে বলা হয় “রো রাইস”, এর দাম দ্বীগুন এখানে। ন্যাচারাল পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফলমূলের দামও বেশি, গ্রীন হাউজে উৎপাদনের তুলোনায়, এবং শ্বাধে-গন্ধে অতুলনীয়। কোনো প্রকার কেমিক্যাল ছাড়া তৈরি বা উৎপাদিত ফল-মূল, শাঁখ-সব্জি যা ন্যাচারাল ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে এবং যা পুষ্টিতে ভরা এবং শরীরের জন্য উপযোগি, কারণ সূর্যের আলোতে এসমস্থ খাবার ন্যাচারাল পদ্ধতিতে পরিপূর্ণতা লাভ করছে বিধায় এসব খাবারে রয়েছে নানা ধরণের রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা, যা গ্রীন হাউজে উৎপাদিত খাবারের ভেতর নেই, এমনকি ভিটামিন বি-১৭ যা মানব জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য।

বিশ্বের নতুন প্রজন্ম ওষুধের ব্যবহার এবং অসুখের থেকে দুরে থাকতে সর্বক্ষন ইকোলজিকাল ফুডের সন্ধানে, একই সাথে নতুন নতুন খাবারের রেসিপি আসছে যা ঝড় তুলছি পাশ্চত্যে এবং গড়ে উঠছে নতুন জীবন-পদ্ধতি যা এক বিশ্বয়কর ব্যপার। আজ প্রায় ৪০ বছর পরে মনে হচ্ছে আমি আমার ছোট্টবেলাকে ফিরে পেয়েছি এবং অবাক হচ্ছি যে যেসব জিনিষের সঙ্গে ছোটবেলাতে পরিচিত ছিলাম তা এখন দেখছি নতুন করে ইউরোপ! অথছ বাংলাদেশ হঠাৎ কেন যেন পুরোনো ঐতিহ্যকে ছেড়ে কেমিক্যাল জীবনযাপনের দিকে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে! কেন মাটির ন্যাচারাল উর্ভর শক্তিকে নষ্ট করা হচ্চে বিষ মিশিয়ে? সুস্থ স্বাস্হ্য পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ইকোলজিকাল উৎপাদনে যা করা সম্ভব শুধু সোনার বাংলায়। কারণ কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুকরণ এবং অনুসরণ করুক সারা বিশ্ব এটাই হবার কথা, কারণ বাংলাদেশের পলিমাটির উর্ভর ক্ষমতা শুধু সোনার বাংলাতেই রয়েছে। তাইতো কবিগুরু বলেছেন “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্ম ভুমি”।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে।