চলন্ত বাস থেকে বৃদ্ধ বাবাকে মারধর করে ফেলে দিয়ে সেই বাসে মেয়ে জরিনা খাতুনকে (৪৫) খুনের নেপথ্যে ডাকাতি নয়, পারিবারিক দ্বন্দ্ব খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। পরিকল্পিতভাবে জরিনাকে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী দূরের কেউ নন, তার নিজের মেয়ে জামাই নূর ইসলাম। ওই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বাদী হয়ে নিজেই অজ্ঞাতদের আসামি করে আশুলিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। শাশুড়িকে হত্যায় মাত্র ১০ হাজার টাকায় বাসচালকের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন তিনি। আর পুরো ঘটনার মধ্যস্ততা করেছিলেন নূর ইসলামের মামা ও তার বিয়ের ঘটক মো. স্বপন।

গত ৯ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নূর-স্বপন ছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন নূরের মা আমেনা বেগমও। গতকাল শুক্রবার রাতে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)। তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত টাঙ্গাইলগামী সেই মিনিবাসের চালক, সহকারী ও দুই হেলপার এখনো রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

ঘটনার এক সপ্তাহ পর হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মিনিবাসটি জব্দ এবং ঘটনায় জড়িত তিন জনকে গ্রেপ্তারের পর আজ শনিবার এসব তথ্য জানান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘বছর পাঁচেক আগে মামা স্বপনের মধ্যস্ততায় রোজিনা ও নূর ইসলামের বিয়ে হয়। এরপর থেকে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকত। মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে সাংসারিক কলহ হলেই আশুলিয়ায় ছুটে আসতেন জরিনা খাতুন। মেয়েকে নির্যাতন করায় জামাইকে শাসাতেন; বেয়াইনকেও (মেয়ের শাশুড়িকেও) শাসাতেন তিনি। এ নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল নূর ইসলামের।’

কুমার মজুমদার বলেন, ‘এদিকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের অবনতির জন্য শাশুড়ি জড়িনাকেই দায়ী করতেন তিনি। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। সম্প্রতি কলহ প্রকট আকার ধারণ করলে নূর ইসলাম ও তার মা আমেনা বেগম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন স্বপনের সঙ্গে। নিজেদের সাংসারিক বিষয়ে নাক গলানোয় শাশুড়িকে সরানোর জন্য তারা পরিকল্পনা করেন- জরিনাকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যেন সে আর তাদের বাড়িতে না আসে। পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয় যেন কেউ বুঝতে না পারে। জরিনাকে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হবে। আর তার সঙ্গে থাকা জরিনার বৃদ্ধ বাবাকে মারধর করা হবে। যেন তিনি নিজেই ডাকাতি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ঘটনা ঘটেছে বলতে পারেন। বৈঠকে ঘটক স্বপন ঘাতক মা-ছেলেকে বলেন, “রোজিনারে সরায় দেওয়া কোনো বিষয় না। মাত্র ১০ হাজার টাকা দাও সমাধান করে দিচ্ছি।”

ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, ‘মেয়ের পারিবারিক কলহ মেটাতে ঘটনার দিন (৯ নভেম্বর) দুপুরে সিরাজগঞ্জ থেকে মেয়ে রোজিনার বাড়ি আশুলিয়ায় আসেন জরিনা ও তার বৃদ্ধ বাবা আকবর আলী মন্ডল। বেয়াইয়ের বাড়িতে দুপুরের খাবার শেষে বিকেল ৫টার দিকে তারা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। জামাই নূর ইসলাম তাদের টাঙ্গাইলগামী একটি মিনিবাসে তুলে দেন।’

ডিআইজি আরও বরেন, ‘অফ রুটের (সাধারণত সেসব গাড়ির নির্দিষ্ট রুট নেই, যখন যে দিকে যাত্রী পায় তখন সেই দিকে যায়) বাসটি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আগে থেকেই আশুলিয়ার জামগড়া বাসস্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন স্বপন। কিছু দূর না যেতেই বাসের সহকারী ও দুই হেলপার মারধর করে মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে চলন্ত বাস থেকে আকবর আলীকে আশুলিয়া ব্রিজের কাছে ফেলে দিয়ে বাসটি ফের আশুলিয়ার দিকে ফেরত আসে। এরপর বাসের মধ্যে জরিনাকে হত্যার পর লাশ রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায় ভাড়াটে খুনি চালক, সহকারী ও দুই হেলপার। বিষয়টি নূর ইসলামকে জানায় নিহতের বাবা আকবর।’

ডিআইজি জানান, খবর পেয়ে রাত ১১টার দিকে পুলিশ নিয়ে এসে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের মরাগাঙ এলাকা থেকে জরিনার লাশ উদ্ধার করে নূর ইসলাম। এ সময় জরিনার শরীরে কোনো ক্ষত চিহ্ন পাওয়া না গেলেও গলায় কালো দাগ ছিল। ঘটনার পর বোঝার উপায়ই ছিল না হত্যার পরিকল্পনায় কে জড়িত। স্বপনকে আটক করার পর জানা গেছে, ঘটনার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন নিহতের খোদ জামাতা নূর ইসলাম।

জরিনাকে হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, শ্বাসরোধ করে জরিনাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া চারজনকে গ্রেপ্তার এবং ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। এরই মধ্যে হত্যায় ব্যবহৃত বাস জব্দ করা হয়েছে। পলাতক চার আসামির নাম-পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে প্রতিনিয়ত অবস্থান পরিবর্তন করছেন তারা। আশা করা যাচ্ছে, শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ১০ নভেম্বর রাতে আশুলিয়া থানা থেকে মামলাটি ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে ১১ নভেম্বর মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই’র কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।