সারা দেশে চলছে গনহরতাল “স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। সমস্ত শরীরে বইছে একই কথা এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বপনে জাগরণে একই চিন্তা, একই ভাবনা। ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছেলে নাইনে উঠতে বেশি দিন বাকি নেই, বাংলার দুরন্ত মা হারা ছেলে, থাকে তার মামা বাড়িতে। নানা মারা গেছেন তার জন্মের আগে। মামা-মামী এবং মামাতো ভাই-বোনদের আদর যত্নে গড়ে ওঠা এই ভাই মাগুরা শহর ছেড়ে বাস করছে নহাটাতে আমাদের সাথে। তখন ছোট, জানিনে যে সে আমার আপন ভাই নয়, ফুপাতো ভাই। কখনও ভাবনাতে এটা আসেনি। একই সংসারে আর দশজন ভাই-বোনের মত সেও পরিবারের এক আপনজন। সরনার্থীর ঢেউ বয়ে চলছে তৎকালীন বাংলার বিশ্ব গ্রাণট্রাং রোড যা শুরু হয়েছে ফরিদপুর থেকে এবং শেষ হয়েছে যশোর বেনাপোল, পরে ঢুকেছে ভারতে।

দেশের নির্যাতিত, নিপিড়ীত বাঙ্গালী দেশ ত্যাগ করছে বর্বর পাকিস্তানীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য। পথে কেও বাচ্চা প্রসব করে ফেলে চলে যেতে দ্বিধাবোধ করছে না। এমন সময় আমি ছোট তবুও বড় ভাইদের সাথে দুঃখের মাঝে সুখের আনোন্দে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। যে সব বাচ্চাদের ফেলে রেখে চলে গেছে তার মধ্যে ছিল এক পরিচিত নাম, হারাণ। ফেলে যাওয়া হারাণ হারিয়ে ছিল হরতালের সময় তার মার কোল থেকে, তাই নহাটা (মাগুরা জেলা) বাজারের এক কর্ণার থেকে অন্য কর্ণারে হামাগুড়ু দিয়ে চলাফেরার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠে সেই হারাণ। পরে জানাগেলো জন্মেছিল হারাণ প্রতিবন্ধী হয়ে তাই তাকে ফেলে চলে যায় তার পরিবার। হরতাল চলছে, যুদ্ধ শুরু হতেই রাতের আঁধারে হঠাৎ আমার এই ভাই রাসেদ, আরেক ভায়ের সাথে প্লান করে সরনার্থিদের সঙ্গে রওনা দেয় ভারতের উদ্দেশ্যে। সময় লেগেছিল বেশ কয়েক দিন যখন আমরা জানতে পারলাম রাশেদ ভাই মুক্তি যোদ্ধায় যোগদান করেছেন। তখন কেউ জানতো না কতদিন এ যুদ্ধ চলবে। আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করা, তার জন্য ভালো ট্রেনিং দরকার বিধায় ভারত সরকার তখন এ সুযোগ করে দেয়। দীর্ঘ ছয় মাস ট্রেনিং শেষে আমার ছোটকাকা নজরুল ইসলাম মৃধা ফিরে এসে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে যোগদান করেন।

রাসেদ ভাই বাংলাদেশে ঢোকেন সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাস, ১৯৭১ সালে। তার বাবা, মরহুম যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আব্দুল মাজেদ বাহিনীর সদস্যের সমন্বয়ে যখন তিনি যুদ্ধে রত কোনো এক সময় জানান যে রাসেদ ভাই যশোর জেলার ভেতরে হাজিপুর মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সাথে জড়িত রয়েছেন। যুদ্ধ চলছে বিশাল আকারে সারা দেশে। বাঙ্গালীরা জঙ্গলে, কচুড়িপানার তলে, পাটের বোনে, ধানের ক্ষেতে, মাটির তৈরি মরিচার তলে। সাত কোটি বাঙ্গালীরা সর্বত্রে। রাজাকার এবং পাকবাহিনীর পরাজয় ছাড়া কোনো উপায় নেই, বাঙ্গালীর রক্তে বয়ছে তুফান, তাঁরা গায়ছে দেশের গান।- “আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অশ্ত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি”। সবার মুখে একই কথা তা হল “এদেশ ছাড়বি কিনা বল”? যুদ্ধ চলছে। হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এল আমাদের পরিবারে। বিরাট কিছু পেতে, দিতে হোল এক সাগরের রক্ত, দিতে হোল ভালোবাসা, দিতে হোল মা-বোনদের ইজ্জত, উৎসর্গ করতে হোল রাশেদ ভাইয়ের জীবন। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর একটি অপারেশন শেষ করে হাজীপুর বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা। তারা মাগুরা-ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী শৈলকূপার কামান্না গ্রামে মাধবকুণ্ডু নামের এক ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে রাত্রি যাপনের জন্য অবস্থান নেন।

রাজাকারদের মাধ্যমে তাদের এ অবস্থানের খবর শৈলকূপা ও মাগুরার পাক বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। এই খবরে শৈলকূপা ও মাগুরার পাক সেনারা ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে ওই বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাক হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। সে সময় ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তাদের মধ্যে রাশেদ ভাইও ছিলেন। রাজাকারের বাচ্চারা এমনটি নিমকহারামী করেছিল সেদিন। বাড়ির মালিক এখনও সেই অবস্থায় বাড়িটিকে রেখে দিয়েছেন। কামান্না গ্রামের গণকবরে শুয়ে আছেন আমাদের ভাই রাসেদ। জাতির কাছে আমার প্রশ্ন- ২৭ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাতে একসঙ্গে শহীদ হয়েছিল এই বাংলাদেশের জন্য। কতজন তা জানে? জানা হয় নি অনেক অজানা আজও। ২৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার অকাল মৃত্যু বাংলার স্বাধীনতার জন্য। কেউ তো তা নিয়ে মিছিল করেনি, যেন কামান্না দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়! এই মূহূর্তে মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। রাসেদ ভায়ের মত লাখো শহীদের রক্তে বাংলাদেশ। আজ তা হয়েছে দূর্নীতি গ্রস্ত বাংলাদেশ। যার যা খুশি সে তাই করছে। যারা দিয়েছে তারা কি পেয়েছে? যারা কিছু করেনি তারা করছে আজ ভোগ। ৪৬ বছর পার হতে চলেছে বলিনি কাউকে আজো। কিন্তু সময় এগিয়েছে সম্পর্কগুলো রক্তের শিরায় প্রবাহিত হলেও ডিজিটাল যুগে থেকে যায় লাভ-ক্ষতির হিসাবে। “আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে” সেই ছোট্ট বেলার মুখস্ত কবিতা যেন এই বৃদ্ধ বয়সেও দুর্বোধ্য লাগে। কারণ তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি বলে।প্রতি বছর ২৬ সে নভেম্বর কামান্না গ্রামের কথা মনে পড়ে, কারণ সেখানে রয়েছে রাশেদ ভায়ের কবর সঙ্গে ২৬ জন নাম জানা অচেনা ভাইয়েরা। ২৭ জন ভায়ের গণকবর যে গ্রামে, স্বাধীন বাংলার জন্য যে গ্রামে ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে ২৭ জন শহীদ ভায়েরা কি পেয়েছে সেই গ্রাম? আমি জানিনে। তবে বড় জানতে ইচ্ছে করে। যে পরিবারের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ সে পরিবারের লোক হয়ে কি করে দুর্নীতি এবং কুশিক্ষাকে সাপোর্ট দেই? শাসন, শোষণ ও ভাষণ নয় দুর্নীতি মুক্ত পরিবার ও দেশ চাই। তাইতো আমার সংগ্রাম দুর্নীতি এবং কুশিক্ষা মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম, হৃদ্যতা ও মানবতা ফিরে পাবার সংগ্রাম। হাত জোড় করি সারাদেশের মানুষের কাছে আসুন এক হয়ে একসাথে হাতে হাত রেখে গড়ি রাশেদ ভায়ের দেশ। যে দিয়েছে তার সব। শুধু আপনার, আমার, সবার জন্য। সেদিনের সেই ফেলে যাওয়া প্রতিবন্ধী হারাণ হারিয়ে গেছে। রাশেদ ভাই শহীদ হয়েছে। স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে দেখি, আজও তোমার কথা মনে রাখি। যে স্নেহ এবং প্রীতি রয়েছে হৃদয়ে লিখা দিয়েছ যা ছোটবেলা আঁকি।

ভুলি নাই প্রিয় ভাই, ভুলি নাই। তাইতো যেখানেই থাকি শুধু তোমাকেই দেখি। তুমি শুধু ভাই নয়, তুমি আমার বাংলাদেশ। রাশেদ ভাই, তুমি এবং তোমার বন্ধুরা ঘুমিয়ে আছো শান্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে সেই কামান্না গ্রামে। লাখো সালাম তোমাদেরকে সাথে আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা। ইতি তোমার ছোট ভাই রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে।