ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিসহ খ্যাতনামা ২২টি গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করে তাতে বিভ্রান্তমূলক ‘সংবাদ’ প্রচার করার অভিযোগে এনামুল হক নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-২। তিনি পিএইচডি গবেষক। পরিবারের পক্ষ থেকে অপহৃত হওয়ার অভিযোগের দু’দিন পর আজ শনিবার সকাল ৭টায় রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনায় এনামুল হকের বিরুদ্ধে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন। এর আগে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে এনামুল হককে ‘অপহরণ’ করা হয় বলে অভিযোগ তোলে তার স্বজনরা। তারা জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশে বুধবার রাতে আশকোনার একটি বাসা থেকে বের হওয়ার পর এনামুলকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ বাবদ এক লাখ টাকা আদায় করা হয়। এই বিষয়ে বৃহস্পতিবার দিনগত গভীর রাতে দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তারা।

এনামুল হককে গ্রেপ্তারের বিষয়টি র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ারুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এনামুল দেশের বিভিন্ন অনলাইন নিউজপোর্টালের ওয়েবসাইট ক্লোন (কপি) করতেন।’

র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার (সিও) মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, এনামুল হক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর বৃত্তি পেয়ে কোরিয়ায় পিএইচডি গবেষণায় চলে যান। সেখানকার কিওংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (কেএনইউ) পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তার বাবার নাম ফজলুল হক। গ্রামের বাড়ি পাবনায়। কোরিয়াতে বসেই বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন, সময় টেলিভিশনসহ ২২টি খ্যাতনামা গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করে তা পরিচালনা করতেন এনামুল হক।’

মহিউদ্দিন ফারুকী আরও জানান, বাংলাদেশে বসে নিজস্ব মাস্টার কার্ড ব্যবহার করে গণমাধ্যমের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওয়েব ডোমেইন কিনতেন, এরপর কোরিয়াতে বসে নকল সাইট তৈরি করে তা প্রকাশ করতেন। বেশির ভাগ সময় হুবহু কপি করে নিউজ দিলেও মাঝে-মধ্যে নিজের ইচ্ছেমতো সরকারবিরোধী লেখা সেসব সাইটে প্রচার করতেন তিনি। এসব নকল সাইট ভিজিট থেকে যে আয় হতো, তার ৭০ শতাংশ ছাত্রশিবিরের তহবিলে জমা পড়তো। নকল সাইট তৈরির সঙ্গে বাংলাদেশ, কোরিয়া ও ইতালিতে তার রয়েছে বিশাল একটি চক্র। র‌্যাব কর্মকর্তা ফারুকী আরও জানান, এনামুল হক আজ সকালে ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় আসেন। এখান থেকে কোরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে নিখোঁজ বলে দাবি করা ইনিই সেই পিএইচডি গবেষক এনামুল হক। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি অপহৃত হননি। গ্রেপ্তার এড়িয়ে কৌশলে কোরিয়া যাওয়ার জন্য নিজেই আত্মগোপনে ছিলেন।

র‌্যাব সূত্র জানায়, এনামুলের চক্রটি ২০১৩ সাল থেকে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। গত তিনমাস ধরে তারা ব্যাপকহারে বাংলা ভাষার গণমাধ্যমগুলো নকল করা শুরু করে। খ্যাতনামা গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করতে চক্রটি গত ১৯ সেপ্টেম্বর একটি ফেক ওয়েবসাইট নিবন্ধন নেয়।

এনামুলের বড় ভাই কামরুজ্জামান মাসুদ জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে গত ২৩ অক্টোবর দেশে এসেছিলেন এনামুল। বুধবার রাত ১টার দিকে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজে পিএইচডি এই গবেষকের ফেরার কথা ছিল। বুধবার সকালে শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসে বিমানবন্দরের কাছে আশকোনায় এক বন্ধুর ছোট ভাইয়ের বাসায় ওঠেন। রাত ১০টার দিকে নিজের ছোট হ্যান্ডট্রলি আর ল্যাপটপের ব্যাগ কাঁধে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশাযোগে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হন তিনি। তাকে রিকশায় উঠিয়ে বন্ধুর ছোট ভাই হ্যান্ডশেক করে তাকে বিদায় দেন। এই দৃশ্য ওই এলাকার সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে।

মাসুদ আরও জানান, রাত ১১টা পর্যন্ত মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে তার কথাও হয়। কিন্তু ১১টার পর থেকে তার মোবাইল সংযোগ বন্ধ পান তারা। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিল এনামুল। তার নিখোঁজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার স্বজন ও বন্ধুরা স্ট্যাটাস দেয়। সেখানে মোবাইল নম্বরও দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ‘অপহরণকারী’ পরিচয়ে এনামুলের পরিবারের কাছে ফোন আসে। শুক্রবার ভোর ৬টার মধ্যে দেড় লাখ টাকা দাবি করে দুর্বৃত্তরা। পরে কথিত অপহরণকারীদের দেয়া নম্বরে এক লাখ টাকা পাঠিয়েছেন তার পরিবার। কিন্তু এক ছেলের বাবা এনামুলকে ফেরত দেওয়া হয়নি। আজ দুপুরের দিকে দক্ষিণখান থানা থেকে তাদের জানানো হয়, এনামুল র‌্যাবের হেফাজতে আছেন।