টঙ্গীতে তাবলীগ জামায়াতের জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে শনিবার দুই পক্ষের মধ্যে রক্ত ক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এঘটনায় এক মুসল্লী নিহত এবং উভয় পক্ষের দুই শতাধিক মুসল্লী আহত হয়েছে। তাবলীগ জামাতের দিল্লীর নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা সাদ গ্রুপ এবং দেওবন্দ কওমি পন্থী মাদ্রাসার অনুসারী ঢাকার কাকরাইল মারকাজের মুরব্বী মাওলানা জুবায়ের গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় ইজতেমা মাঠে থাকা বেশ কয়েকটি প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। বিকেল পর্যন্ত টঙ্গী ও এর আশপাশের এলাকায় এ সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে নিহতের নাম ইসমাইল হোসেন মন্ডল (৭০)। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার মিলিয়াপাড়া গ্রামের মৃত খলিল মন্ডলের ছেলে। তিনি মাওলানা সা’দ গ্রুপের অনুসারী বলে টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি এমদাদুল জানিয়েছেন।

পুলিশ, তাবলীগের মুসুল্লীরা ও স্থানীয়রা জানান, গাজীপুরে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে প্রায় বছর খানেক ধরে তাবলীগ জামায়াতের মুসল্লীরা দিল্লীর নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা সা’দ গ্রুপ এবং দেওবন্দ কওমি পন্থী মাদ্রাসার অনুসারী ঢাকার কাকরাইল মারকাজের মুরব্বী মাওলানা জুবায়ের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর জের ধরে উভয় পক্ষ বিশ্বইজতেমা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগে টঙ্গীর বিশ্বইজতেমা ময়দানে পৃথক তারিখ নির্ধারণ করে জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। সা’দ পন্থীরা ৩০ নবেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী এবং জুবায়ের পন্থীরা ৭ ডিসেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫দিন ব্যাপী পৃথক জোড় ইজতেমার ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মুসল্লীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নিতে থাকে। এসময় তারা প্রতিপক্ষ মাওলানা সা’দ অনুসারীদের মাঠে প্রবেশে বাধা দেয়। বাধা পেয়ে তারা টঙ্গীর বাটা রোড ও কামারপাড়া রোডসহ ইজতেমা ময়দানের আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নিতে থাকে। এসময় ইজতেমা মাঠে প্রবেশ পথের গেইট বন্ধ করে জুবায়ের অনুসারীরা লাঠি সোটা নিয়ে অবস্থান নেয় এবং জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে আসা সা’দ পন্থী মুসুল্লীদের ইজতেমা ময়দানে প্রবেশে বাধা দেয়। সা’দ পন্থী মুসুল্লীরা শুক্রবার পর্যন্ত ময়দানে প্রবেশ করতে না পেরে আশেপাশের বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান নেন। এসব মুসল্লীরা শনিবার ভোরে পুনঃরায় ময়দানে প্রবেশ করতে গেলে জোবায়ের পন্থীদের বাধার মুখে পড়েন। এসময় জুবায়ের অনুসারীরা ইজতেমা মাঠের টয়লেটের ছাদ থেকে বাইরে অবস্থানকারী সা’দ অনুসারীদের ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এসময় সা’দ অনুসারীরা পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এসময় সা’দ অনুসারী কয়েকহাজার মুসল্লী গেইট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মাঝে মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষ ইজতেমা ময়দানসহ আব্দুল্লাহপুর ও আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। এ ঘটনায় আতংকিত হয়ে পথচারীসহ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দিকবিদিক ছুটোছুটি শুরু করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষে ইটপাটকেলে ও লাঠির আঘাতে সা’দ অনুসারী ইসমাইল হোসেন মন্ডল ঘটনাস্থলেই নিহত ও উভয়পক্ষের অন্ততঃ দুই শতাধিক মুসুল্লী আহত হন। স্থানীয়রা হতাহতদের উদ্ধার করে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রেরণ করে।

এদিকে টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি মো. এমদাদুল হক ঘটনার সত্যত্যা স্বীকার করে বলেন, টঙ্গীর বিশ্বইজতেমা ময়দান এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা সকাল থেকেই ময়দান এলাকায় জলকামান ও সাজোঁয়া যানসহ অবস্থান নেয়। সকাল থেকে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেলা ১১টার পর পরই দু’পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হলে ময়দানের বাইরে থাকা মুসুল্লীরা ফটকের তালা ভেঙ্গে এবং সীমানা প্রচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সংঘর্ষকালে ইটপাটকেলে ও লাঠির আঘাতে উভয়পক্ষের দুই শতাধিক মুসুল্লী আহত হয়েছেন। পরে অতিরিক্তি পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। আহতদের টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

তাবলীগ সুরা সদস্য ভারতের সা’দ পন্থী কাকরাইলের মুরুব্বী মাওলানা আব্দুল্লাহ শেখ ও গাজীপুরের মুরুব্বী হাজী সিরাজ সিকদার জানান, প্রতিবছরের মত এবারও তারা বিশ্বইজতেমা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগে টঙ্গীর বিশ্বইজতেমা ময়দানে জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। সে অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। গত বিশ্ব ইজতেমাকালে মুরুব্বীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ পরবর্তী বিশ্ব ইজতেমা ও জোড় ইজতেমার এ সময়সূচি ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১১, ১২ ও ১৩ জানুয়ারী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

তিনি আরো জানান, পূর্ব ঘোষিত ৩০ নভেম্বরের জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ বিদেশের হাজার হাজার মুসল্লীরা টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের দিকে আসতে থাকে। জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে আসা এসব মুসুল্লীরা ইজতেমা ময়দানে ঢুকতে গেলে মুফতী মাসুদুল করিমের নেতৃত্বে দেওবন্দ কওমিপন্থী মাওলানা জুবায়ের অনুসারী বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের বাধা দেয়। কয়েকদিন আগে থেকেই জুবায়ের অনুসারীরা লাঠি-সোটা নিয়ে ময়দানে প্রবেশের ফটকগুলো বন্ধ করে দিয়ে সেখানে অবস্থান নেয়। ফটক দিয়ে তারা কাউকেই ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে দেয়নি। শনিবার ভোরে সা’দ পন্থীরা ময়দানে প্রবেশ করতে গেলে জুবায়ের পন্থীদের বাধার মুখে পড়েন। এসময় জুবায়ের অনুসারীরা সা’দ অনুসারীদের ওপর হামলা চালায় ও মারধর করে। এতে এক মুসল্লী নিহত ও কয়েকশ’ আহত হয়। তিনি জুবায়ের অনুসারীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

অপরদিকে প্রতিপক্ষের দেওবন্দ কওমি পন্থী তাবলীগ মুরুব্বী মো. মাহফুজ জানান, ৭ ডিসেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বরে তাদের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণা শুনে সা’দ পন্থীরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় দু’পক্ষেকে ডেকে নিয়ে নির্বাচনের আগে জোড় ইজতেমা স্থগিত রাখার অনুরোধ জানানো হয়। সেখানে ঊভয় পক্ষই ওই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। তারপরও সা’দ পন্থী কয়েক হাজার তাবলীগ মুসুল্লী শনিবার ভোরে সরকারের কাছে দেয়া তাদেও দেয়া প্রতিশ্রুত ভঙ্গ করে ইজতেমা ময়দানে জোড় ইজতেমা করার জন্য ময়দানে ঢুকার চেষ্টা করছেন এবং ফটকে ফটকে জড়ো হয়েছেন। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ জোনের সিনিয়র সহকারি কমিশনার থোয়াই অংপ্রু মারমা বলেন, ইজতেমা ময়দানের বাইরে কয়েক হাজার মুসুল্লী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেয়ায় এবং তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে যানবাহন চলাচল বিঘিœত ও যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুর সোয়া একটার দিকে ধীরগতিতে গাড়ি চলাচল শুরু হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা জোনের উপ কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, টঙ্গীতে মুসল্লীদের দু’পক্ষের সংঘর্ষের কারণে বিমানবন্দর সড়কের এক দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ হোসেন জানান, ওই ঘটনায় এ হাসপাতালে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শতাধিক মুসুল্লী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহত মুসুল্লীদের আগমন ক্রমাগত বাড়ছে।