সুইডেনের নর্থের একটি শহর। এই শহরের নাম সুইডেনের সবার জানার কথা, যারা বার বার না হলেও একবার স্কিইং করছে জীবনে। শহরটির নাম ট্যান্ডোদলেন। শীতের ছুটিতে সবাই স্কিইং করতে দেশ-বিদেশ থেকে এখানে এসে থাকে। স্কিইং এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা এবং গড়ে উঠেছে হোটেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কটেজ। এখানে শুধু স্লালম নয়, ক্রস কান্ট্রি স্কিইং করা হয়ে থাকে। জীবনে স্লালম স্কিইং দেখেছি টিভিতে, এটা শীতের দেশে উইন্টার স্পোর্টসের একটি বড় রকম বিনোদন। ডিসেম্বর ১৯৯৩ সাল, প্লান করলাম স্কিইং করতে সুইডেনের নর্থের এই ছোট্ট শহর ট্যান্ডোদলেন যাব, পাঁচ ঘন্টার গাড়ী জার্নী শেষে এসে হাজির হলাম ট্যান্ডোদলেন।

বন্ধু-বান্ধবীরা শীতের ছুটিতে এখানে এসেছে এবং তাদের মুখে অনেক গল্প শুনেছি যা ছিল আমার জন্য কল্পনা মাত্র। আজ সেই কল্পনা হয়েছ বাস্তব। বাংলার দুরান্ত ছেলে পড়েছে এক সুইডিস রমনীর প্রেমে, তাকে ইমপ্রেস করতে আজ জীবনের এই ঝুঁকি? নাকি সত্যি সত্যি স্কিইং করার প্রবনতা হয়েছে বন্ধুদের গল্প শুনে?সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কিইং স্কুলের একজন ইন্সট্রাক্টরের থেকে ঘন্টা খানেক প্রশিক্ষণের শুরুতে বার বার স্কির উপর দাঁড়াই আর পড়ি, এ ভাবে চলতে থাকল সংগ্রাম এবং মনে পড়েছিল সেদিন পারিবে না একথাটি বলিবে না আর, একবারে না পারিলে দেখ শতবার। শেষে দাড়াতে শিখলাম, মনে হচ্ছিল জীবনে প্রথম দাড়াতে শিখেছি তাই মনকে বুঝ দিতে শুরু করলাম ছোট বেলার ছড়া দিয়ে হাঁটিতে পারে না শিশু না খেয়ে আছাড়। বাইরের টেম্পারেচার মাইনাস ২৫-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড, পরনে রয়েছে স্কিইং-এর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা ওভারঅল (গাউন্ড) এবং স্কিইং-সু, সঙ্গে এক ধরণের চশমা সব মিলে দেখতে মনে হচ্ছে চাঁদের দেশের যাত্রি।হাতে গ্লোভস এবং দুটো লাঠি যা জীবনের বন্ধু, পায়ে স্কিইং-জুতার সাথে রয়েছে স্কি যা স্পেশাল ভাবে তৈরি করা এবং দিব্বি বরফের মধ্যে ঝড়ের গতিতে চলে। এসেছি যখন তখন জীবন বাজি রেখে আজ এই অসাধারণ কাজ করতে হবে, যা জীবনে কোনদিন এর আগে করিনি। এবার উঠতে হবে লিন্ড পথে। সে আবার কি? একটি দড়ির মত যা ধরে রাখতে হবে দুই পাইয়ের মাঝখান দিয়ে, পরে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে সেটা সংযুক্ত থাকায় দিব্বি উপরের দিকে নিয়ে যাবে। লিফ্টে করে রওনা দিলাম ২ থেকে ৩ কিলোমিটার পাহাড়ের উপরে। পাহাড়ের টপে উঠে লিফ্টের দড়ি ছেড়ে দিলাম। নামতে হবে স্কিইং করে সমতল ভুমিতে। এখন স্কিইং করে নিচে নামতে টেকনিক্যালি একটু বামে একটু ডাইনে কিছুটা নাচের ভঙ্গি করে রিলাক্সের সাথে মুভ করতে হবে। যারা বেশি ভিতু তারা নিচের দিকে তাকাবে না।

প্রসঙ্গত এই লিন্ড পথ গুলো গ্রীন, রেড় এবং ব্লাক নামে পরিচিত। গ্রীন পথ বেশি ঢালু নয় আস্তে আস্তে নিচের দিকে যাবার ব্যবস্থা অনেকটা ২০-৩০ ডিগ্রীর অ্যাঙ্গেলের পথ, রেড পথ ৪০-৬৫ ডিগ্রী এবং ব্লাক পথ ৬০-৮০ ডিগ্রী। যারা সারাজীবন ধরে স্কিইং করছে তাদের জন্য অথবা যারা মরনকে বরণ করতে চাই তাদের জন্য ব্লাক পথ। আমি দুটোর কোনটার মধ্যেই পড়িনে, তাই স্বাভাবিক ভাবেই গ্রীন পথটাই নেবার কথা প্রাথমিক পর্য়ায়ে আমার, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টা না জেনে এবং ভুল বসত নিয়েছি ব্লাক পথ যা তিন কিলোমিটার উপরে, মনে হচ্ছে মহাশূন্যে উঠছি। নিচেরদিকে তাকাতে দেখি শুধু মেঘ আর মেঘ। প্রিয় বান্ধবীর দেখা মিলেছিল শেষ বারের মত লিফ্টে ওঠার আগে। কথা ছিল গ্রীন পথে দেখা হবে, ভুল বসতে আমি চলে এসেছি মহাশূন্যে। সাহস পালিয়েছে অনেক আগে, ভয়ও মনে হচ্ছে ভাগছে জীবন থেকে। নিজের মধ্যে কোন রকমই কন্ট্রোল নেই, থাকবে কি করে জীবনে স্কিইং এই প্রথম তার পর কোন প্রাকটিস ছাড়া ভুল বসত, ভুল পথে। না জেনে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছি। হঠাৎ আমি কন্ট্রোল হারিয়ে উড়ন্ত ভাবে নিচের দিকে, তুলনা করা যেতে পারে অনেকটা স্পাইডার ম্যানের সঙ্গে, ‘আই এম ফ্লাইং লাইক স্পাইডার ম্যান’। তুসার পড়া বন্ধ হয়েছে, তুলোর মত নরম এবং হাটু সমান উঁচু হয়েছে, আকাশ বেশ পরিস্কার।

আমার ল্যান্ডিং সবার দৃষ্টি আকর্শন করছে, সবার ধারণা আমি পৃথিবীর সেরাদের মধ্যে একজন যে স্কিইং-সাথে ফ্লাই করতে এক্সপার্ট । জীবনে মিরাকেলের নাম শুনেছি, বাস্তবে তার সন্ধান মেলেনি আজ প্রথম মিরাকেল আমার জীবনে বন্ধু হয়ে এসেছে। ল্যান্ড করলাম তুষারের মধ্যে যা অনেকটা খড়ের পালার মত করে জমা হয়েছে। মনের অজান্তে ল্যান্ডিং হয়েছে প্রফেশোনাল ওয়েতে। সবায় করতালি দিয়ে আমাকে সংবর্ধনা করছে। আমি মরণ থেকে বেঁচে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি এবং সেন্স আছে বলে মনে হচ্ছে। সেদিন আল্লাহ পাক রাব্বুল আল্আমীনকে সত্যি মন দিয়ে ভালোবাসা এবং তাঁর ক্ষমতা এবং রহমতের কথা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রিয় বান্ধবী ছিল আমার হবু বধু মারিয়া, ল্যান্ডিংয়ে তাঁর চোখে ছিল, শুধু ভালোবাসার জল। সে তখন বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি জীবন্ত এবং তাঁর কাছে ফিরে এসেছি কোন রকম ইনজুরড ছাড়া। মারিয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল তার ভিতরে নতুন প্রেমের ছোয়া লেগেছে ‘ইট মাস্ট হ্যাভ বিন লাভ’ যা এসেছিল জীবনে সেদিন আবারও নতুন করে যেনো ‘ট্রু লাভ ট্রু লাইফ’। ঠান্ডার দেশে স্বাভাবিক ভাবেই শীতের এ্যাক্টিভিটিসের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, এখানের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা এবং ব্যবহার সম্পর্কে চেনাজানা অবশ্যই প্রয়োজন, তাই মনে করি নতুন পরিবেশে বা নতুন জীবনে নতুন কিছু চেনা ও জানা শিক্ষার একটি অংশ, কিন্তু তা যেনো ইনোসেন্ট ওয়েতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, সাথে ভয়কে জয় করাও শিখতে হবে ভালোবাসা দিয়ে। মনে রাখতে হবে স্বদেশ ছেড়ে এসেছি বিদেশ, গড়তে হবে এক সুন্দর পরিবেশ, আসে যদি জীবনে বাঁধাবিঘ্ন, করতে হবে মোকাবিলা তার জন্য। সঙ্গিনী যদি থাকে পাশে, পাছে লোকে কিছু বলে? তাতে কি আঁশে।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে।