বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে বুধবার গাজীপুরে বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও ভাংচুর করেছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানায় ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং মহাসড়ক অবরোধ করেছে। এসময় একাধিক পয়েন্টে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সাংবাদিক ও পুলিশসহ অন্ততঃ ২৮ জন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ সর্টগানের গুলি ও টিয়ার সেল ছুড়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে এদিনও বেশ কয়েকটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। জেলার শিল্পাঞ্চলে পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ ও কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবী ভ্রান্ত ধারণা থেকে শ্রমিকরা অযৌক্তিকভাবে গত কয়েকদিন ধরে এ আন্দোলন করছে বলে করেছে।

পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, সরকার ঘোষিত মুজুরী কাঠামোয় বৈষম্যের অভিযোগে তা দূর করে ন্যূনতম বেতন ভাতা বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের দাবিতে বুধবারেও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। এদিন ওই দাবীতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের গাজীপুরা এলাকার হোপলোন অ্যাপারেলস, নাওজোড়ের দিগন্ত সোয়েটার, ভোগড়া, ইসলামপুর, সাইনবোর্ড ও বোর্ডবাজার এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা সকালে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে সকাল ৯টার দিকে শ্রমিকরা মিছিল নিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে। বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পরিত্যাক্ত বস্তা ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাংচুর শুরু করে। এতে মহাসড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসময় মহাসড়কের উপর থেকে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকদের সঙ্গে শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি মো. এমদাদুল হক জানান, সকাল ৯টার দিকে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গাজীপুরা এলাকার মন্ডল গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে আশেপাশের কারখানার সামনে সড়কের উপর গিয়ে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে। এসময় তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য আশেপাশের বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের আহ্বান জানায়। এক পর্যায়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্থানীয় লোপা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিলসহ পাশর্^বর্তী গাজীপুরা এলাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গিয়ে অবস্থান নিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এতে ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং মহাসড়কের উভয় দিকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মহাসড়কের উপর থেকে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এতে পুলিশসহ কয়েকজন আহত হয়। সময় টিভির স্থানীয় প্রতিনিধি সৈয়দ মনিরুল আলম এসময় ভিডিও ফুটেজ নেয়ার সময় পুলিশের লোকজন তাকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে বলে জানিয়েছেন ওই সাংবাদিক। একপর্যায়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ টিয়ার সেল ও সর্টগানের গুলি ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. কামাল হোসেন জানান, একই দাবিতে এদিন সকালে টঙ্গীর বিসিক এলাকায় বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে কারখানা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আশেপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা অংশ নেয়। এসময় কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা লোহার রড, লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে বিভিন্ন পোশাক কারখানা সামনে গিয়ে তাদের সঙ্গে আন্দোলনে দিতে ওইসব কারখানার শ্রমিকদেরকে আহ্বান জানায়। এসময় টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকার নর্দান গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ না দিয়ে বরং আন্দোলনরত শ্রমিকদের ধাওয়া দিয়ে বিসিক পানির ট্যাংকি পর্যন্ত নিয়ে গেলে দুই পক্ষের শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষে টিকতে না পেরে নর্দানের শ্রমিকরা তাদের কারখানায় ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এসময় বহিরাগত শ্রমিকরা নর্দানে হামলা চালাতে গেলে সেখানকার শ্রমিকরা কারখানার ছাদ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও বাহিরে গরম পানি ছুঁড়তে থাকে। পরে তারা বিকল্প পথে নর্দান কারখানা থেকে বের হয়ে চলে যাওয়ার সময় উত্তেজিত বহিরাগত শ্রমিকরা নর্দানে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করলে উত্তেজিত শ্রমিকরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও কর্মীদের বাধা দেয়। এর আগে পার্শ্ববর্তী প্যাট্টিয়ট ইকো অ্যাপারেলস নামের একটি নতুন কারখানায় ব্যাপক ভাংচুর চালায় বহিরাগত শ্রমিকরা। কারখানার প্রধান ফটক ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে ভাংচুরের পর সেখানে একটি মোটর সাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দমকল বাহিনীর কর্মীরা যেতে না পারায় অবশেষে কারখানার নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পরে পুলিশ সেখানে গিয়ে টিয়ার সেল সর্টগানের গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

এদিকে একই দাবিতে এদিন সকাল হতে গাজীপুর মহানগরের নাওজোর এলাকায় দিগন্ত সোয়েটার কারখানাসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে তারা বিক্ষোভ করে কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উপর অবস্থান নেয়। এসময় তারা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন পরিত্যাক্ত বস্তা ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে মহাসড়কের উভয় দিকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এতে পুলিশসহ কয়েকজন আহত হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে শ্রমিকদের হামলায় চ্যানেল টোয়েন্টিফোর-এর গাজীপুর প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম আহত হয়। উত্তেজিত শ্রমিকরা তার ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটিও ভাংচুর করে। একপর্যায়ে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে ওই মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়।

এছাড়াও প্রায় একই সময় ভোগড়া, ইসলামপুর, সাইনবোর্ড, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ি ও কাশিমপুর এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা এদিন কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করে। এসময় তারা কারখানা ও গাড়িসহ বিভিন্ন মালামাল ভাংচুর এবং বিভিন্ন পয়েন্টে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে। অবরোধকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টেয়ার সেল ছুড়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তারা জানান, কারখানার কর্তৃপক্ষ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বেতন ভাতা শ্রমিকদের দিচ্ছে। কিন্তু বহিরাগত কিছু শ্রমিক বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের জোরপূর্বক কারখানা থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে সড়কে গন্ডগোল করেছে। ভুল ধারণা থেকে শ্রমিকরা অযৌক্তিকভাবে এ আন্দোলন করছে। সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামোয় পোশাক কারখানার সিনিয়র-জুনিয়র অপারেটরদের মূল বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খাতের ভাতাদি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের আগের ঘোষিত গেজেটে কর্মীদের দক্ষতা অনুযায়ী তাদের গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে বেতন ভাতা কম দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। বেতনের টাকা হাতে পেলেই শ্রমিকদের ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বিভিন্ন মহল সিনিয়র অপারেটরদের ভাতাদি বৃদ্ধি করা হয়নি বলে গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনে ইন্দন দেয়। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে তারা অযৌক্তিকভাবে বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবীতে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ ও আন্দোলন করে ভাংচুর করে আসছে। শ্রমিক অসন্তোষ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারখানা দেখা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে কয়েকটি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব কারখানা খুলে দেওয়া হবে।

গাজীপুরের শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহেব আলী পাঠান জানান, সরকার ঘোষিত মুজুরী কাঠামো অনুযায়ী বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গাজীপুরের ইতোমধ্যে কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কারখানা বন্ধ থাকার কথা ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টঙ্গী, গাজীপুরা, হোতাপাড়া, কোনাবাড়ী ও কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাকসহ জেলার শিল্পাঞ্চল এলাকায় ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতােেয়ন করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত বিজিবি মোতায়েন থাকবে। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বুধবার (৯ জানুয়ারি) সকাল থেকে বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। গত চারদিন ধরে ঢাকার মিরপুর, সাভার-আশুলিয়াসহ গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও মহাসড়ক অবরোধ করছেন।