নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে তিস্তা নদীর আশে-পাশ সহ কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক অবৈধ বোমা মেশিন (ড্রেজার) দিয়ে অবাধে চলছে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। দিন-রাত সমানতালে মাটির ভূ-গর্ভ থেকে ভারী মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করে অবৈধ ভাবেই কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন পাথর খেকু প্রভাবশালীরা । প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে রহস্যজনক ভুমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ ও পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবীতে বুধবার(৯ই জানুয়ারি) বিকেলে ডিমলা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে মানববন্ধন করা হয়। ডিমলা সদরের সুটিবাড়ী মোড়ে স্মৃতি অম্লান চত্তরে ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধনে সাংবাদিক ছাড়াও সর্বস্তরের জনসাধারন অংশ গ্রহন করেন।এ সময়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দ্রুত সময়ে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানিয়ে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, ডিমলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মাজহারুল ইসলাম লিটন,সাধারন সম্পাদক সহিদুল ইসলাম, তিস্তা নিউজের সম্পাদক সরদার ফজলুল হক,সাংবাদিক আলতাফ হোসেন চৌধূরী, বাসদ ইয়াছিন এ্যাড শ্যামল গ্রুপ কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি ও তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডাঃ সৈয়দ লিটন মিয়া তালুকদার, অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিটকারী গোলাম মোস্তফা,ডিমলা প্রেসক্লাবের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও অনলাইন প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিনুল ইসলাম সুজন প্রমুখ।

মানববন্ধনে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে আদালতে রিটকারী ডিমলা পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের গোলাম মোস্তফা বলেন, অবৈধভাবে বোমা মেশিন দিয়ে এসব পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে আমি হাইকোর্টে মামলা করি। হাইকোর্ট আমার মামলা আমলে নিয়ে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা জারী করে দেয়। কিন্তু এখন দেখছি হঠাৎ করে গয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সামসুল সহ প্রভাবশালী মহলেরা জোট বেধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার ও ডিমলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)মফিজ উদ্দিন শেখ কে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন পুর্বে থেকে পুনরায় অর্ধশতাধিক অবৈধ বোমা মেশিন বসিয়ে পাথর উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। যা উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞার সামিল। প্রশাসন নিজেদের এ ব্যাপারে যতই আড়াল করতে চাননা কেনো তাদের রহস্যময় কারন উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের কাছেই স্পষ্ট।

মানববন্ধন শেষে অবিলম্বে উপজেলার ভু-গর্ভস্থ ও তিস্তা নদী থেকে সব ধরনের বালু পাথর উত্তোলন বন্ধ করা, বালু পাথর উত্তোলনের সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক আইনানুগ ব্যবস্থা, বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে উত্তোলনকৃত পাথর স্তুপ জব্দ করা ও সাংবাদিকদের স্বাধীন ভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তার দাবী জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ডিমলা থানা ওসি’র বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।এদিকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন মেশিন ও স্থান্তরিত করা ট্রাক্টরের শব্দে এলাকাবাসীরা চরম বিপাকে পড়েছে । পাথর উত্তোলনকারীদের প্রভাবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে এলাকায় বসবাসরত সাধারন মানুষজন। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আইন মানছেননা কেউ। এতে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকা ও নদী সহ বিভিন্ন স্থানে অনুমতিহীন অবৈধভাবে বোমা মেশিন বসিয়ে মাটির তলদেশ থেকে পাথর উত্তোলনে তিস্তা ব্যারাজ ও নদী সংরক্ষনের নির্মিত কোটি কোটি টাকার অবকাঠামো হুমকীর মুখে পড়েছে। লুট করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার খনিজ সম্পদ।

টানা গত তিনদিন ডিমলা উপজেলা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সামসুল হকের নেতৃত্বে সেখানে তার পুত্র আলম ও রাজা একাধিক বোমা মেশিন বসিয়ে পাথর উত্তোলন করছে।এ ছাড়াও উপজেলার নদী বেষ্টিত টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন, খালিশা চাপানী ইউনিয়ন,পুর্বছাতনাই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালীরা কেউ একটি কেউবা একাধিক মিলে অর্ধশতাধিক বোমা মেশিন দিয়ে দেদারছে অবৈধ ভাবে তিস্তা নদীর আশ-পাশ সহ ফসলি জমিতে,পুকুর ও বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোর রাস্তা সংলগ্ন জমিতে অবাধে পাথর উত্তোলন করছেন!

এ সময়ে গয়াবাড়ী ইউনিয়নের-রাশু মোহন্ত,হাবীব ইসলাম,বাছেদ মিয়া,আব্দুল কাদের, টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের সিরাজুল ইসলাম মজিদ মিয়া,মর্জিনা বেগম,মমিন, খালিশা চাপানী ইউনিয়নের-আবুল হোসেন,সামসুল ইসলাম,পুর্বছাতনাই ইউনিয়নের আবদুল্লাহ, জিয়াউর রহমান,রউফ সহ একাধিক এলাকাবাসী অতিতের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, এভাবে পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে এ বছরে তিস্তার বন্যায় পুর্বের সব ক্ষতির রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। কেনোনা এর পুর্বেও এভাবে অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে ২০১৭ সালে তিস্তার নদীর বন্যায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়েন উপজেলার নদী বেষ্টিত ছয়টি ইউনিয়নের-রাস্তা-ঘাট,পুল-কালর্ভাড,ব্রীজ,বিদ্যালয়,কমিউনিটি ক্লিনিক,মসজিদ,ফসলি জমি, তিস্তা ব্যারাজ ও নদী সংরক্ষণের নির্মিত বাধ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো এবং একাধিক গ্রাম ।সব হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন কয়েক শতাধিক পরিবার। উত্তোলনকৃত পাথর বহনেও নদী রক্ষা একাধিক বাধ,উপজেলার প্রায় সকল সড়ক আক্রান্ত হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়। এবারেও ইতিমধ্যে একাধিক গ্রাম, ফসলি জমি, তিস্তা ব্যারাজ ও নদী সংরক্ষণের নির্মিত বাধ,রাস্তা,পুল-কালভার্ড সহ নদী সংরক্ষনের বিভিন্ন অবকাঠামো দিনে দিনে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ সময়ে অনেকে বলেন, গয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সামসুল হক সহ পাথর উত্তোলনে জড়িত প্রভাবশালীরা প্রতিটি মেশিন বাবদ প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা উত্তোলন করে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুন নাহার,ডিমলা থানার ওসি মফিজ উদ্দিন শেখ কে মোটা একটি অংশের মিনিময়ে ম্যানেজ করে এই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

গয়াবাড়ী ইউনিয়ন ভুমি সহকারী কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের বেশ কিছুদিন যাবত সামসুল চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বোমা মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এখানে সামসুল চেয়ারম্যানের দুইপুত্র আলম ও রাজা সহ অনেকেই পাথর উত্তোলন করছে। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৫ দফা লিখিত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
ডিমলা থানার ওসি মফিজ উদ্দিন শেখ বলেন, আমি বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে কিছুই জানিনা।
এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, ডিমলায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি আমার জানা নেই! প্রতিনিয়িত বিজিবি ও পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। ডিমলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তবিবুল ইসলাম বলেন, খনিজ স¤পদ মন্ত্রণালয় থেকে এখানে কোন কোয়াড়ি দেওয়া হয়নি। তবুও আশ্চর্য জনক ভাবেই এখানে অবৈধ বোমারু মেশিন দিয়ে কেনো পাথর উত্তোলন চলছে তাতে আমিও বিস্মিত। নীলফামারী জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছ থেকে জেনেছি, অচিরেই অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

মহিনুল ইসলাম সুজন,বিশেষ প্রতিনিধি॥