বর্তমান পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে গবেষণার প্রতিযোগিতা। নানা বিষয়ে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে তারা বেশ উঠে পড়ে লেগেছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করছে তাঁরা চেষ্টা করছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বা ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিয়ে কাজের সমন্বয় ঘটিয়ে তাদের থিসিস পেপার তৈরি করতে। অনার্স-মাস্টার্স-থিসিস স্টুডেন্টদের জন্য এখন এ ধরণের কাজ পাওয়া কঠিন হতে চলেছে। প্রথমত সুপারভিশনের অভাব, দ্বিতীয়ত এদের থিওরিটিক্যাল শিক্ষা পদ্ধতিতে যথেষ্ট গ্যাপ রয়েছে বিধায় মডার্ন শিল্প ও কলকারখানাগুলো তেমন ক্রিয়েটিভ ফল পাচ্ছে না এবং এগুলো তেমন সাড়াও দিচ্ছে না। এ কারণে বেশ হতাশ হয়ে পড়ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা হচ্ছে তবে চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ না হওয়ার কারণে শিল্প ও কলকারখানাগুলো ঠিক মতো মান উপযোগী প্রযুক্তি তৈরি করতে পারছে না।

কী কারণ থাকতে পারে এক্ষেত্রে? উত্তরে বলবো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও পুরোনো পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রশিক্ষণে ঢোকার পর তারা রেগুলার পড়াশুনা বন্ধ করেছে। তাদের ধারণা অনেকটা এরকম যে, তারা ৪-৫ বছর যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাই দিয়ে বাকি পঁচিশ বছর পার করে দিবে। এ ধরণের মন-মানসিকতার শিক্ষকরা সমাজের এবং দেশের শিক্ষাঙ্গনের জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে। এ থেকে রেহাই পেতে হলে শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত পড়াশুনো করতে হবে, জানতে হবে নতুনত্বের খবরাখবর। একজন ভালো শিক্ষক হতে হলে তাকে একজন ভালো ছাত্র হতে হবে, মানে রেগুলার পড়াশোনা করতে হবে।

একটি ইন্ডাস্ট্রির উদাহরণ হিসেবে গারমেন্টস সেক্টরকে ধরা যেতে পারে। এদের লেবার, সুপারভাইজার, ম্যানেজারসহ যারা কর্মরত রয়েছে তারা বাধ্য প্রতিনিয়ত ফলোআপ থেকে শুরু করে লিড টাইম, কস্ট মনিটরি সব কিছুই গুরুত্বের সাথে করতে। এতে সবাই প্রসেস অরিয়েন্টেশনের সঙ্গে পুরো সময় সংযুক্ত এবং ডেইলি বেসিক সাপ্লাই চেইনের সম্পর্কে সচেতন হতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ গার্মেন্টস সেক্টরে রয়েছে ডিমান্ড এবং সাপ্লাই কনসেপ্ট, রয়েছে ডেলিভারি এগ্রিমেন্ট, রয়েছে লেবার, রয়েছে অরগানাইজেশন, রয়েছে ম্যানেজমেন্ট এবং সর্বোপরি রয়েছে কাস্টমার।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে তার নিজের গতিতে, যেখানে সব থাকতেও মনে হচ্ছে কিছুই নেই। এখানে হয়তোবা বছরে একবার কোন রকম একটু অডিট হয় যাস্ট ফর ফর্মালিটিজ রক্ষার্থে। শিক্ষকদের এই স্লোমোশনের লাইফ স্টাইলে এরা দিব্যি সমাজের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে সমাজে অনেক সময় অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। আমরা যারা সচারাচর বলে থাকি শিক্ষকরা জাতির কারিগর কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কারিগর ঠিকই তবে তা মানসম্মত সুশিক্ষার নয়, কুশিক্ষার। আর তার প্রতিফলন যা আমরা দেখছি তা হোল দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার ইত্যাদি ইত্যাদি।

উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে তারা শিক্ষা প্রদানের সঙ্গে রিসার্স করছে, নতুন চিন্তাধারার আবির্ভাব ঘটিয়ে প্রশিক্ষণকে নতুনত্বের সমন্বয়ে মানসম্মত সুশিক্ষা দিতে সক্ষম হচ্ছে। যেমন আমেরিকাতে দেখা যাচ্ছে যে যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট হারে ছাত্রছাত্রী ভালো ফলাফল না করতে পারে বা চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে থাকে তখন সে ক্ষেত্রে শিক্ষককে নিয়মিত কৈফিয়তের সঙ্গে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী যদি ডিমান্ড, সাপ্লাই এবং ডেলিভারি না থাকে, যদি ভালো ম্যানেজমেন্ট না থাকে, যদি কাস্টমার খুশি না থাকে তাহলে যেমন অর্থনীতির অপচয় ঘটে, তেমন শিক্ষাঙ্গনের দুর্বল ম্যানেজমেন্টের কারণে জাতির অধঃপতন ঘটতে থাকে।
যে দেশের সমস্ত সেক্টরই দুর্নীতিতে ভরা সেখানকার শিক্ষকদের অবস্থা কী হতে পারে? ভেবে দেখা হয়েছে কি? নাকি শুধু পুলিশ বাহিনীর উপর সব দোষ চাপিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের?

কারা জাতির প্রশিক্ষণের জন্য দায়ী? ছোটবেলা বাব-মা, পরে সংযুক্ত করা হয়েছে শিক্ষকদের। ভালো বাব-মা না হলে বা ভালো শিক্ষক না হলে কিভাবে পাব সুশিক্ষা? আমরা এখনও জানিনে শিক্ষা এবং সুশিক্ষা কি? আমরা কি পড়াচ্ছি বা কি গড়ছি দেশে? দেশের সারাটি সময়ের লেখালেখিতে বলা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা নকল করে, তারা পড়াশোনা করে না, তারা রাজনীতি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনও জোর গলায় বলা হয়না এসব নোংরামির কারণ কি? বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। আমাদের ছাত্রছাত্রীরাই যদি ফল হয়ে থাকে তাহলে তাদের বৃক্ষ কারা?

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করতে হবে শিক্ষকদের দৈনিন্দন কাজকর্মের ওপর মনিটরিং করা। আমি এর আগে লিখেছি জাতির উন্নতি আনতে হলে যেমন শিশুশিক্ষার আশু প্রয়োজন ঠিক তেমনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুশীল প্রশিক্ষণেরও খুবই প্রয়োজন। জানিনে কেন এত বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ঠিকমতো মনিটরিং করা হয়নি স্বাধীনতার এত বছরের মধ্যেও? যদি সত্যি আমরা মনে করি দেশে সুস্থ্য মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের দরকার তাহলে আর দেরি নয়। জাতির স্বার্থে, নতুন প্রজন্মের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, এমনকি গোটা বিশ্বের স্বার্থে সত্ত্বর শিক্ষাঙ্গনকে সাজিয়ে গুছিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা হোক। বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষকদের সুপ্রশিক্ষণের আশু ব্যবস্থা করা হোক। বাংলাদেশের ৫০ বছর জন্মদিনকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের প্রথম গোল হোক সুশিক্ষার লক্ষে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সুসমন্বয় গড়ে তোলা।
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে।