গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের একমাত্র পুরুষ জিরাফটি অবশেষে মারা গেছে। ফলে পার্কের জিরাফ পরিবার এখন পুরুষ শূণ্য হয়ে পড়েছে। পার্কের চিকিৎসকের অবহেলায় ওই জিরাফটি মারা গেছে বলে দাবি করেছেন পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তবে যক্ষ্মা ও ক্রোনিক ওয়াস্টিং রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই জিরাফটি মারা গেছে বলে দাবি করেছেন পার্কের সহকারি ভেটেরেনারী সার্জন ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি দায়িত্বে অবহেলার কথা অস্বীকার করেছেন। ফলে পার্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তঃকোন্দলের কারণে পার্কের প্রাণীরা এখন হুমকির মুখে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবী করেছেন।

পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.রফিকুল ইসলাম জানান, গাজীপুরের শ্রীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে মোট ৮টি জিরাফ ছিল। এর মধ্যে একটি মাত্র পুরুষ এবং বাকী ৭টি স্ত্রী জিরাফ। গত প্রায় তিন মাস ধরে পুরুষ জিরাফটি অসুস্থ্যতায় ভুগছিল। ওই জিরাফটি পাতা জাতীয় খাবার খেলেও দানাদার খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি পার্কের মেডিকেল বোর্ডের সদস্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জারি বিশেষজ্ঞ মো. রফিকুল আলম, ঢাকা চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটরসহ কয়েকজন চিকিৎসকের নজরে দেয়া হয়। গত ১৫ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) ওই পুরুষ জিরাফটিকে দেখা যায় নি। পরদিন বুধবার সকালে পার্কের কর্মীদের কাছে সংবাদ পেয়ে পার্কের কোর সাফারি এলাকার আফ্রিকান সাফারি বেষ্টনী থেকে জিরাফটিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে অসুস্থ্য জিরাফটি মারা যায়। পরে তার মৃতদেহের নমুনা সংগ্রহ করে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। ঘটনারদিন পার্কের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে এক রকম চিকিৎসকের দায়িত্ব অবহেলার মধ্যেই জিরাফটি মারা যায়। তার আবহেলার কারণেই এর আগে আরো ৬টি জিরাফ মারা গেছে। শুধু জিরাফ নয় পার্কের চিকিৎসকদের অবহেলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পশু-পাখি অকালে মারা গেছে।

পার্কের ওই কর্মকর্তাসহ বন্যপ্রাণি সুপারভাইজার মো. আনিসুর রহমান, সরোয়ার হোসেন খান আরো জানান, পার্কের প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্য সেবার জন্য দু’জন চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন। অথচ সহকারি ভেটেরেনারী সার্জন ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী পার্ক এলাকায় অবস্থান না করায় প্রায়শঃ অসুস্থ্য প্রাণীদের নিয়ে পার্কের কর্মীদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। নিজাম উদ্দিন পার্কে রাত যাপন করেন না। তিনি থাকেন পার্ক থেকে প্রায় ১৫কিলোমিটার দূরে শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের আবাসিক এলাকায়। তিনি দিনে দু-একবার পার্কে আসলেও দিনেই চলে যান। তিনি পার্কের প্রতিষ্ঠাকালীণ ভেটেরিনারী সার্জন (চিকিৎসক)। এমতাবস্থায় কয়েকমাস আগে ওই পার্কে হাতেম সাজ্জাত মো. জুলকার নাইন নামের ভেটেরিনারি অফিসার ওই পার্কে যোগ দেন। তিনি নিজাম উদ্দিনের কথা ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ বন্য প্রাণিরা যেহেতু কথা বলতে পারে না। তাই তাদের যতœ নিতে হয় খুব কাছে থেকে। কিন্তু ওই চিকিৎসক তা করেন না। এ ব্যাপারে পার্কের প্রকল্প পরিচালককেও অবগত করা হয়েছে।

এব্যাপারে পার্কের সহকারি ভেটেরেনারী সার্জন ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী জানান, জিরাফের গড় আয়ূ ২০ বছর। ১৭ বছর বয়সের এ জিরাফটি প্রায় তিন মাস ধরে অসুস্থ্যতায় ভুগছিল। তার চিকিৎসা সেবার জন্য জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডা, এ বি এম শহিদুল্লাহকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠণ করা হয়। মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী অসুস্থ্য জিরাফটির নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছিল। বুধবার মৃত জিরাফটির ময়না তদন্ত সম্পন্নের পর পার্কের এক পাশে ৮ফুট গভীর গর্তে চুন দিয়ে তাকে মাটি চাপা দেওয়া হয়। ময়না তদন্তে জিরাফটির দেহে যক্ষ্মা ও ক্রোনিক ওয়াস্টিং রোগের ভাইরাস জীবানু পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই রোগের জীবানু বহনকারী পার্ক এলাকার বানরের মলমূত্র থেকে পানির মাধ্যমে ওই জিরাফের দেহে প্রবেশ করে। এতে বৃদ্ধ বয়সে সে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। পার্কে রোগ জীবাণু সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েও কোন প্রতিকার হয় নি।

পার্কের ওই চিকিৎসক দায়িত্বে অবহেলার কথা অস্বীকার করে জানান, পার্কের প্রাণীগুলোর নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কোন প্রকার গাফলতি করা হচ্ছে না। গত কিছুদিন আগে পার্কের দু’টি ব্ল্যাক সোয়ান (কালো হাঁস) এর হদিস মিলছে না। এ বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে হাস দু’টির মৃত্যু হয়েছে বলে ময়না তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম আমার উপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু আমি এতে রাজী না হয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আসল ঘটনা খুলে বলি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রফিকুল ইসলাম ও তার লোকজন বুধবার আমার উপর হামলা চালিয়ে আমাকে মারধর করে এবং হুমকি দেয়। এতে আমি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। এ ঘটনায় আমি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের নাম উল্লেখ করে শ্রীপুর থানায় একটি জিডি করি। এতে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.রফিকুল ইসলাম ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে হয়রানীর জন্য নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।

শ্রীপুর থানার ওসি জাবেদুল ইসলাম জানান, তর্কবিতর্ক ও হুমকির অভিযোগে বুধবার থানায় একটি জিডি করেছেন পার্কের এক কর্মকর্তা।

পার্ক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে এ পার্কের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১০টি জিরাফ আমদানী করা হয়। তারা এ পার্কে চারটি শাবকের জন্ম দেয়। চারটি বাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চা সাব-এডাল্ট অবস্থায় মারা যায়। এছাড়াও ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯সাল পর্যন্ত কয়েক মাসের ব্যবধানে মোট ৬টি এডাল্ট জিরাফ মারা গেছে। এদের মধ্যে কয়েকটি পুরুষ জিরাফও ছিল। বেঁচে থাকা অবশিষ্ট ৮টি জিরাফের মধ্যে একমাত্র পুরুষ জিরাফটি মঙ্গলবার রাতে মারা যায়। সর্বশেষ পুরুষ জিরাফটির মৃত্যুর পর এ পার্কে এখন ৭টি মাদি জিরাফ বেঁচে আছে। ফলে পার্কের জিরাফ পরিবার এখন পুরুষ শূণ্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় ও বিশেষজ্ঞদের মতে পার্কের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তঃকোন্দলের কারণে এ পার্কসহ পার্কের প্রাণীরা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।