ওর চাহনীতে হাজারো প্রশ্ন। উত্তরও জানা নেই। কিশোরী শিক্ষার্থী তুলির জীবনটা এখন যেন বর্ণহীন। রঙ নেই। রঙের মিশ্রনে শিল্পির হাতের তুলি যেমন পারে জীবনের ছবি তুলে ধরতে, আঁকার মধ্য দিয়ে। কিন্তু রঙহীন তুলি শুধুই উপকরণ। তেমনি তুলি আক্তারও চার মাস আগের রঙিন স্বপ্নের বাস্তবায়ন এখন দেখতে পায়না। আশাও করেনা। নেই কোন ভরসা।

সমাজের এক নরকীট, বখাটে নাঈম ওর রঙিন স্বপ্ন তছনছ করে দিয়েছে। এখন ভবিষ্যত দিনগুলোয় রঙিন স্বপ্ন ওর কাছে মহা অনিশ্চয়তা। গোটা জীবন বিবর্ণ হয়ে গেছে। আর দশটা কিশোরী বন্ধুর সঙ্গে সেইদিনও তুলি স্কুলে যায়। পহেলা সেপ্টেম্বর। সকাল নয়টা। গল্প করছিল ধুলাসার মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে। কোন কিছু বোঝার আগেই বখাটে নাঈম আচমকা তুলির পেটের নিচে একটি ছুরি বসিয়ে দেয়। প্রায় ছয় ইঞ্চি ভেতরে ঢুকে ছুরি আটকে যায়। পাষন্ড, বর্বর ওই নরঘাতক বিদ্ধ ছুরি বের করতে ফের টান দেয়। কিন্তু না। ছুরি আটকে যায় সজোরে। ছুরির প্লাস্টিক বাট বখাটের হাতে চলে আসে। ছুরি থেকে যায় তুলির পেটে। রক্তে ভিজে যায় তুলির পাজামা-জামা থেকে সবকিছু। অবিরাম রক্তক্ষরণে কাতরাতে থাকে মেয়েটি। নাড়ি-ভুরি অনেকটা বের হয়ে যেতে থাকে। কেবল নবম শ্রেণি পড়–য়া, মেয়েটা অচেতন হয়ে যায়। এক ঘন্টার মধ্যে কলাপাড়া হাসপাতালে। সন্ধ্যার মধ্যে বরিশাল শেবাচিমে।

সেখানেই প্রায় এক মাস। সীমাহীন দারিদ্র্য। তাঁর মধ্যে এতো বড় বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি। কলাপাড়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ বহু হৃদয়বান মানুষ এগিয়ে আসেন তুলির চিকিৎসা সহায়তায়। চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। নয়টি ছিদ্র হয়ে যায় খাদ্য নালীতে। কেটে ফেলতে হয় অনেকটা। অপারেশন করা হয়। সৃষ্টিকর্তা মুখ ফিরে তাকান। কিন্তু অঘটনের চার মাস পরও তুলি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। মেয়েটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বাবা নিজাম উদ্দিন লেবারের কর্ম করেন চিটাগংএর কর্ণফুলিতে। চার সন্তানের বড়টার বিয়ে দিয়েছেন। এখন পাঁচজনের সংসারের ওর বাবাই একজন উপার্জনোক্ষম। তাও যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ২০০৯ সালের এক মাদকের মামলায় পুলিশ নিজাম উদ্দিনকে কারবারি দেখিয়ে চার্জশীট দিয়েছে। আদালতে কিংবা কোথাও খোঁজ-খবর না নেয়ায় সাজাপ্রাপ্ত থাকায় প্রায় ২০ দিন আগে মহিপুর থানা পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরন করে। নিজাম এর কিছুই জানতনা বলে পরিবারের দাবি। এখন জেল হাজতে তিনি। তুলির মা আকলিমা বেগম দৌড়-ঝাপ করছেন।

কিছুই হয়নি। অসুস্থ তুলির ফলোআপ চিকিৎসা করাবেন, ওষুধ কিনবেন। সন্তানদের পেটের যোগান দিবেন, না মামলার তদবির করাবেন। কিছুই এখন এ পরিবারের হচ্ছে না। তুলি এখন ফের অসুস্থ। বমি করছে কখনও। ঠিকঠাক খেতে পারছে না। স্বপ্ন ছিল তুলির, লেখাপড়া শিখে বাবা-মাসহ ছোট্ট ভাইবোনদের একটু যোগান দেবে। কিন্তু এখন নিজের বেচে থাকতে সুচিকিৎসা, পরিবারের খাবার যোগান, সব মিলে অথৈ সাগরেরর মাঝখানে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে। শুক্রবার (৪ জানুয়ারি) কলাপাড়ার ইউএনও তানভীর রহমান তুলির পরিবারকে আরও কিছু আর্থিক সহায়তা বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এসেছেন। তখন তুলিকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতেই দু’চোখের পানি ঝরাচ্ছিল। যেন ছোট্ট মেয়েটি ছোট্ট শিশু হয়ে গেছে। ওর কাছে নিজের সুস্থতার চেয়ে বাবাকে কাছে পাওয়াই বড় প্রত্যাশা। পুলিশ তুলির মায়ের করা মামলার অপর কোন আসামি আজ অবধি গ্রেফতার করতে পারেনি। যে বখাটে হাজতে রয়েছে (নাঈম) তাঁকে স্থানীয়রা আটকে পুলিশে দেয়। অসহায় তুলির শুকনো মুখটিতে শুধু ওর নয় যেন আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি তাঁদের অসহায়ত্ব ফুটে আছে। যে মেয়েটি স্বপ্ন দেখছিল মানুষের মতো মানুষ হওয়ার।

শিক্ষার সিঁড়ি পেরুনোর প্রথম ধাপে আটকে গেল মানুষরূপী এক বখাটের তান্ডবে। আমরা, সমাজ, সরকার কিংবা রাষ্ট্র এক তুলির মৌলিক অধিকার রক্ষার কাজটি ঠিকঠাক করতে পারিনি। সমাজের হৃদয়বান শিক্ষার্থীরা তাঁদের এক বোনের মতো মনে করে যে যা পেরেছে তা দিয়ে প্রথম দফার চিকিৎসা চলেছে। এখন বখাটে যারা গ্রেফতার হয়নি তাদের মামলা প্রত্যাহারের হুমকি। চিকিৎসার আর্থিক যোগান দেয়া। জেলে আটক বাবার মুক্তি। এসব প্রতিবন্ধকতার পরে আদৌ সুস্থ হয়ে তুলি পারবে ফের স্কুলে যেতে- এমন দুর্ভাবনায় মেয়েটা অস্থির। যেন কোমর সোজা করে একটু দাঁড়াতে চায় মানবরূপী দানবের হামলায় মৃত্যুদুয়ার থেকে কোনমতে ফিরে আসা তুলি। ফের তুলির জীবনসহ শিক্ষাজীবনে রঙের ছটা পারবে ছড়াতে, এমন দুশ্চিন্তা তাঁড়া করে বেড়ায় গোটা পরিবারকে। তুলি কি পারবে নিজের জীবনে তথা পরিবার কিংবা সমাজে দাঁড়িয়ে রঙের মিশ্রনে তুলির আঁচড় ছড়াতে ? পারবে কি শিক্ষাজীবনের গতি ফেরাতে- এটাই এখন দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে আছে। যখন ফিরছিলাম। অশ্র“সজল চোখে তুলি ও তাঁর অসহায় মা আকলিমা শত দুঃখকষ্ট, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে শুধু এইটুকু বলছিল,ক্ষীণস্বরে। স্যার মোরা কি বচার পামু।