মাদারীপুর জেলায় মৃৎশিল্প নানা মুখী সমস্যার কারনে এ শিল্প এখন ধ্বংসের পথে বললেই চলে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা,প্রযুক্তির উন্নয়ন,নতুন নতুন শিল্পসামগ্রী,অনুকুল বাজারের অভাব, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও সামগ্রী তৈরির উপযোগী মাটির অভাবে দিন দিন মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে যাচ্ছে। ফলে মৃৎশিল্পিরা তাদের জীবিকার জন্য এই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছেন। এ শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে হলে সরকারের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে হবে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। মাদারীপুর পৌরসভা লঞ্চঘাট সংলগ্ন,দরগাহ শরীফ এলাকায় কুমার বাড়ি নামে একটি মহল্লা খুবেই সু-পরিচিত ছিলো একসময় । প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগের কথা,কুমার বাড়ি মহল্লায় প্রায় ২০ টি পরিবার বসবাস করত । এই এলাকার মৃৎশিল্পী গোপাল পালের খুবেই সুনাম ছিলেন। তখন এই এলাকায় মুৎশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিলো। মানুষের চাহিদা মত তাদের সাংসারিক জীবনের মাটির তৈরী হাঁড়িপাতিল,থালা-বাসন, কলস,মটকা,ফুলের টব,ঝাঝরসহ বিভিন্ন খেলনা সমগ্রী ইত্যাদি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এই এলাকার ২০ টি পরিবার। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নয়নের কারনে এখন এসকল মৃৎশিল্প ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে প্লাস্টিক,মেলামাইন,স্টিলনেসসহ বিভিন্ন ধাতুর তৈরি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যবহার করছেন ক্রেতারা। ফলে মৃৎশিল্পের ব্যবহার দিন দিন ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে। বর্তমানে মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে। ফলে কুমারবাড়ির গোপাল পালের পরিবারসহ প্রায় লোকজনই ভারতে চলে গেছেন । আবার কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। দুর্গা পাল বলেন, এই মহল্লায় এখন আমাদের পরিবার ছাড়া আর কেহ এই মাটির শিল্পের কাজ করেন না। আগের মত চাহিদা না থাকার কারনে বর্তমানে ধুপতী,প্রদিপ,ঘট,সড়া ও বাচ্চাদের হাড়ি পাতিল ইত্যাদি তৈরী করে বাজারে বিক্রি করি। বর্তমানে কুমার বাড়ির সেই ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে। এদিকে মাদারীপুর চৌরাস্তা রমেশ পালের বাড়ী প্রায় ২০০ বছরের সু-পরিচিত এই মৃৎশিল্প। পুর্ব পুরুষের পুরোনো এই ঐতিহ্য রমেশ পালের পিতার আমল থেকেইে মাটির হাড়ি,টপ,মালসা,ফুলদানী,কলস,বদনা,পানির ঘট,ইত্যাদি তৈরী করত। গত ৫বছর জাবৎ এ মৃৎশিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। রমেশ পালের স্ত্রী সন্ধা পাল(৬৫) বলেন,বর্তমানে ভালো মাটি পাওয়া যায় না। ক্রেতারা প্লাস্টিক ও মেলামাইনের সামগ্রী কেনা কাটায় ঝুকে পড়েছে । ফলে ক্রেতাদের এই মৃৎশিল্পের প্রতি চাহিদা কমে গেছে। আমদের এই পেশায় টিকে থাকা খুবেই কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। তাই আমার ২ ছেলে এখন এই পেশা ছেড়ে শর্ণের দোকানে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। কালকিনি উপজেলার পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ডের চরবিভাগদী গ্রামের কুমার বাড়ীর অনিল পোদ্দার (৮৩) ও সুজিৎ পাল (৭০) এবং নিখিল পাল(৪৫)বলেন,কালকিনি উপজেলায় পাল পাড়া নামে এই মৃৎশিল্পের গ্রামটি মাদারীপুর জেলায় খুবেই সু-পরিচিত। ২৫০ বছর্রে পুরোনো এই ঐতিহ্য। এই পাড়ায় এক সময় ৭০০ থেকে ১০০০ পরিবার মৃৎসিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বর্তমনে ২০০থেকে ২৫০ টি পরিবার এ পেশায় ঝুকে আছে। এই মৃৎশিল্পের চাহিদা না থাকার কারনে বাকি পরিবার ভারতে চলে গেছে। আবার কেহ এ পেশার পাশাপাশী খেতে খামারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আগে এখানে জলের মুটকি,গরুর খাবারের চাড়ি,মুরির চাড়ি,রাইং,বড় চাড়ি, ছোট চাড়ি, ইত্যাতি মালামাল মাটি দিয়ে তৈরী করা হতো। বর্তমানে বাজারে জালের কাঠি,দধির হাড়ি,এই দুটো ছাড়া আর কিছুই বিক্রি হচ্ছে না। তাই এর উপরই আমরা র্নিভরশীল হয়ে কোন রকমের জীবন যাপন করছি । তা দিয়ে কোন রকম আমাদের সংসার চলে।
কুমার পাড়ার মরন পোদ্দার(৪২) ও মাহাজন সুজন পাল(৪০) বলেন,২৫ বছর জাবৎ এ কাজ করে আসছি, বর্তমানে ২০০ টি পরিবার এই পাল পাড়ায় নিভু নিভু অবস্থায় কাজ করে আসছে,আগে এখানে বিভিন্ন শহর থেকে পাইকাররা আমাদের মালামাল কেনার জন্য আসতো। কিন্তু এখন আর পাইকার আসছে না এ মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ার কারনে। মাঝে মধ্যে ২/১টা পাইকার দেখা যায় তাও তাদের চাহিদা মত মালামাল অর্ডার করলে আমরা তা বানিয়ে দেই। পাইকার না থাকায় আমরা নিজেরাই এখন বাজারে ঘুরে ঘুরে দোকানে গিয়ে বিক্রি করি।পালপাড়ার জ্যোদিশ পাল(৬৫) ও শ্যামল পাল(৬৩) বলেন, প্রায় ৫ বছর আগে ২০ থেকে ৩০ টি মটকা বানিয়েছিলাম বর্তমানে ক্রেতাদের চাহিদা না থাকার কারনে বিক্রি বরতে পারছি না। আগে এই মটকা দিয়ে কেহ ধান,মুড়ি,পানি,শরিষা,গম ইত্যাদি রাখার জন্য ক্রয় করতেন । এখন প্লাস্টিরে ড্রাম বের হওয়ার কারনে কেউ এই মটকা কিনছেনা।

রিকতা পাল (৪৮)নামে এক নারী মৃৎশিল্পি বলেন,আমার বাবার বাড়ি শরিয়াতপুর জেলায়,আমাদের পুর্বপুরুষ থেকেই মাটির শিল্পের ঐতিহ্য। পালপাড়া আমার শশুর বাড়ি,এখানে মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মৃৎশিল্প তৈরী করা হতো। প্লস্টিক ছিলভার ও মেলামেইনের কারনে আমাদের এই শিল্পের চাহিদা অনেক কমে গেছে। তাই আমি বর্তমানে মাটির ভিন্ন কিছু তৈরী করার চেষ্টা করছি যা ক্রেতাদের পছন্দ মত এবং দেখলেই কেনার ইচ্ছে জাগবে। আমি গত ১৫ বছর ধরে মাটির কুিমর,হাতি,ঘোড়া,ড্রাগন তৈরী করছি, যা এই মহল্লায় কেউ বানাতে পারে না। আমি আমা/র বাবা ও ভাইয়ের কাছে সিখেছি। আমার এই নতুন মৃৎশিল্প বিদেশে রপ্তানী করা হচ্ছে। এমনকি ঢাকাতে জুটয়াক,আড়ং মার্কেট সহ বিভিন্ন বড় বড় সপিংমলে পাইকারী বিক্রয় করছি। এসব পন্য ক্রেতারা সোপেজে রাখার জন্য ক্রয় করে। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ না থাকার কারনে ক্রেতাদের চাহিদামত পন্য দিতে পারছি না তাই মোটা মুটি ভাবে কোন রকমের বেচে আছি। এই শিল্পটি বাচিয়ে রাখতে হলে আমাদের অর্থের প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশ সরকার যদি আমদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে কোন ঝৃণ-দানের ব্যাবস্থা করে তাহলে এই কাজ করে আমরা সরকারে টাকা পরিষোধ করে এই শিল্পটি বাচিয়ে রেখে লাভবান হতে পারতাম। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া গ্রামের আনন্দ পাল,অশোকপাল ,অনন্তপাল,বাদল পাল ও গনেশ পাল বলেন, এক সময় রাজৈর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে মৃৎশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল ব্যাপক। বৃটিশ আমল থেকেই মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য এই পালপাড়া। এই গ্রামে ২০০টি পরিবার এ পেশায় কাজ করতেন । কাজের চাহিদা না থাকার কারনে বর্তমানে ৫০টি পরিবার কাজ করে কোন রকম দিন কাটাচ্ছে। এ পেশা ছেড়ে বেশীর ভাগ লোক ভারতে চলে গেছে আবার কেহ এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। এখানে এক সময় মাটির তৈরি থালা-বাসন,কলশ, পিঠা তৈরীর সাচ, মাটির ঢাকন, হাঁড়ি-পাতিল,ঝাজর,গরুর চাড়ি,মটকাসহ বাচ্চদের হরেক রকমের খেলনা ইত্যাদি তৈরি করা হতো। ক্রেতাদের এই মৃৎশিল্পের চাহিদা না থাকার কারনে এ পেশা এখন বিলপ্তির পথে হয়ে পড়েছে। বর্তমানে জালের কাঠি ও দধির হাড়ি এবং শীতের মৌসুমে খেজুরের রস সংগ্রোহের জন্য মাটির হাড়ি ইত্যাদি । এছাড়া ক্রেতাদের আর কোন মৃৎশিল্পের চাহিদা নেই বললেই চলে। বৈশাখ ও জৈষ্ট্য মাসে মাটির কলস ও শীতের মৌসুমে খেজুরের রশের হাড়ি একটু বেশী বিক্রি হলেও বছরের বাকি দিনগুলো কর্ম হীন হয়ে কোন রকম দিন কাটাতে হয়। এই পেশায় থেকে বর্তমানে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া করানো বড় কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে। রাজৈর খালিয়া,গোয়ালবাথান,নয়াকান্দি বেশ কয়েকটি কুমারপাড়া এলাকা ঘুরে যানা গেছে প্রোয়োজনীয় উপকরনের মূল্য বৃদ্ধি, পুজির অভাব, প্লাস্টিক ও মেলামেইন এবং এ্যালমনিয়ামের কারনে মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনিয় উপকরন, অর্থ এবং সরকারি সহযোগিতার অভাবে পুর্বপুরুষের এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সরকারী কোনো প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক ঋনের সুযোগ-সুবিধা পেলে এই মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভাব হবে বলে মনে করেন এই অঞ্চলের মৃৎশিল্পিরা।

এবিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন,মাদারীপুর জেলায় প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার পরিবার যেহেতু মৃৎশিল্পে কলনীর বসত ছিলো। সেখেত্রে আগের দিনের মানুষ মাটির হাড়ি,পাতিল,কলস থেকে শুরু করে মাটির বিভিন্ন ধরনের পন্য একটু বেশী ব্যাবহার করা সাধসন্দ বোধ করত। বর্তমানে মানুষ আর্টিফিশিয়াল সিরামিক,মেলামাইন বা অন্যান্য ধাতব এধরনের ব্যাবহার করার ফলে মৃৎমিল্পের বাসন কোশন এসবের চাহিদাটা কমে যাচ্ছে।এই পেশা থেকে আয়করা বর্তমানে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের বাজারজাত করনের সেরকম কোন সুবিদধাও নেই। তারা অর্তনৈতিক ভাবেও অনেকটা কষ্টে আছে। তবে তাদেরকে কোন ধরনের সহায়তাও প্রদান করা হয়না। তবে আমাদের এই শিল্পটাকে বাচিয়ে রাখা উচিৎ এটা আমাদের দেশের ঐতিহ্য। তবে তাদের পন্য গুলো জদি আকর্শনীয় বা বিভিন্ন ধরনের নতুন কিছু তৈরি কার যেমন,ঘোড়া,হাতি, বিভিন্ন ধরনের টপ, কুমির এছাড়া বাচ্চাদের আকর্শনীয় নতুন নতুন ভিন্ন ধরনের খেলনা ইত্যাদি,এবং তারা জদি এই পন্য গুলো মাদারীপুরের বাহিরে কোথাও বাজার জাত করে,তাহলে হয়তো এশিল্পটাকে বাচিয়ে রাখা সম্ভব। তবে তারা আমাদের কাছে তাদের এ বিষয়ে সমস্যার কথা নিয়ে কখনও আসেও নাই। তাদের আবাসিক কোন সমস্যা নিয়ে যদি আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা তা দেখব। সরকার যেহেতু চাচ্ছে দেশে কোন মানুষ কর্মহীন থাকবেনা,শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে না, কোন মানুষ বেকার থাকবে না,বিদ্যুৎহীন থাকবে না,চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে না। তাদের এসব মানবিক সমস্যা জদি থাকে তারা যদি প্রয়াজন মনে করে,তাহলে অবস্যই আমরা দেখব এবং তার পাশাপাশি আমরা তাদের আরো কোন দাবিদাওয়া যদি থাকে তাহলে সরকারের কাছে আমরা উপস্থাপন করবো। অথবা অন্য কোন সংস্থার জদি সহযোগিতা দরকার হয় তাহলে আমরা তাদের ও সহযোগিতা নিবো। তবে এই পেশায় জারা নিয়োজিত আছে তাদের বংশানুক ভাবেই তারা হাড়িপাতিল তৈরি করছে শ্রম সাধ্য এবং মনোযোগিতার সাথে কাজটা করে যাচ্ছে। তাই এ পেশায় নতুন দের দিয়ে তা সম্ভব না। তাই এই কাজটা যাহাতে অব্যাহত রাখতে পারে, এজন্য সকলেই তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করা উচিৎ। আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযেগিতা করার চেষ্টা করবো।

সাবরীন জেরীন,মাদারীপুর।